ডিজিটাল অবসর : প্রযুক্তির নিচে চাপা তরুণ মন
সাদিয়া সুলতানা রিমি:
|
![]() ডিজিটাল অবসর : প্রযুক্তির নিচে চাপা তরুণ মন বর্তমানে প্রায় সব শিক্ষার্থী, পেশাজীবী কিংবা অবসরে থাকা যুবক-যুবতীর হাতে রয়েছে স্মার্টফোন। এই যন্ত্রটির মাধ্যমে তারা মুহূর্তেই যোগাযোগ করতে পারে, ভিডিও দেখতে পারে, গেম খেলতে পারে বা নতুন কিছু শিখতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বহুমুখী প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্যে অধিকাংশ সময় তরুণরা শুধু বিনোদন নির্ভর প্ল্যাটফর্মেই আটকে যাচ্ছে—যেমন: টিকটক, ইউটিউব শর্টস, ইনস্টাগ্রাম রিলস, ফেসবুক স্ক্রলিং ইত্যাদি। এই ব্যবহারের পেছনে রয়েছে এক ধরনের "ডোপামিন ফিডব্যাক লুপ"। প্রতিবার ভিডিও দেখার পর যদি তা ভালো লাগে, মস্তিষ্ক স্বল্প পরিমাণে আনন্দ হরমোন নিঃসরণ করে। এই অনুভূতির পেছনে তরুণরা ছুটতে থাকে—ফলে তৈরি হয় ডিজিটাল আসক্তি, যার প্রভাব পড়ে পড়াশোনা, শারীরিক সুস্থতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মানসিক স্থিতিশীলতার ওপর। এক সময় তরুণরা অবসরে খেলাধুলা করত, গল্পের বই পড়ত, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরতে যেত, পরিবারে সময় কাটাত কিংবা সৃজনশীল কোনো কাজে যুক্ত থাকত। এখন সেই সময়টা অনলাইন বিনোদনের দখলে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা স্ক্রিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেম খেলা, রাত জেগে নেটফ্লিক্স দেখা—এসবই যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিজিটাল অবসরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নেতিবাচক দিক: ১. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি: সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের "সফল জীবন" দেখে নিজের জীবনের প্রতি হতাশা জন্ম নেয়। সবসময় অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে নিজের জীবনকে অপর্যাপ্ত মনে হয়। এই অনুভূতি থেকে তৈরি হয় হীনমন্যতা, যা দীর্ঘমেয়াদে মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ২. ঘুমের ব্যাঘাত: রাত জেগে মোবাইল ব্যবহারে ঘুমের সময় কমে যায়। অনেক তরুণ ঘুমানোর ঠিক আগে পর্যন্ত স্ক্রিনে থাকে, ফলে ব্রেইন আরাম পায় না। এটি শুধু পরদিনের কাজের ওপর প্রভাব ফেলে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে শরীর ও মনকে ক্লান্ত করে তোলে। ৩. মানবিক সম্পর্কের দূরত্ব: অনলাইন ইন্টারঅ্যাকশন যত বাড়ে, ততই বাস্তব জীবনের সম্পর্ক দুর্বল হয়। আগে যেখানে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হতো, এখন একটি মেসেজেই সীমাবদ্ধ। এতে সম্পর্কের গভীরতা কমে যায়। পরিবারেও সময় কাটানো কমে যায়, যার ফলে তৈরি হয় একাকিত্ব। ৪. সৃজনশীলতা ও চিন্তার জড়তা: অবসরে কল্পনাশক্তি কাজে না লাগিয়ে যদি কেবল পরিপাঠ্য কনটেন্ট গ্রহণ করা হয়, তাহলে চিন্তাশক্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। বই পড়া, ডায়েরি লেখা, ছবি আঁকা কিংবা গানের চর্চা—এসব সৃজনশীলতার জায়গা নিচ্ছে অগণিত ভিডিও দেখা। প্রযুক্তি: আশীর্বাদ না অভিশাপ? প্রযুক্তি নিজে কোনো অভিশাপ নয়। এটি একটি যন্ত্র, যার ব্যবহার নির্ভর করে আমাদের সচেতনতার ওপর। সমস্যা হয় তখন, যখন প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতে শুরু করে, আমরা তাকে নয়। বর্তমানে আমরা এমন একটি পর্যায়ে চলে গেছি যেখানে অ্যালগরিদম আমাদের পছন্দ, অভ্যাস ও আচরণ বিশ্লেষণ করে আমাদের সামনে এমন কনটেন্ট হাজির করে, যেগুলো দেখে আমরা আরও বেশি সময় স্ক্রিনে আটকে থাকি। এটি একটি ‘আসক্তির চক্র’, যেখানে আমরা নিজেদের অজান্তেই বন্দি হয়ে পড়ি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যখন কেউ দিনে ৫ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় স্ক্রিনে কাটায় শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য, তখন তার মানসিক স্বাস্থ্যে স্পষ্ট নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আত্মমর্যাদা, মনোযোগ, একাগ্রতা এবং সময় ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি দেখা দেয়। কেন তরুণরা প্রযুক্তির নিচে চাপা পড়ছে? ১. সময়ের অভাব নয়, অভ্যাসের ব্যাধি: অনেক তরুণ বলে, “সময় পাই না”, অথচ প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে কাটায়। এটা সময় ব্যবস্থাপনার নয়, বরং অভ্যাসগত এক দুর্বলতা। যে সময়টা কোনো দক্ষতা অর্জনে ব্যয় হতে পারত, তা নষ্ট হয় অর্থহীন স্ক্রলিং-এ। ২. ডিজিটাল পরিচয়ের চাপ: ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে ‘পারফেক্ট লাইফ’ দেখাতে গিয়ে নিজের বাস্তব জীবনকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়। তরুণরা নিজেরাই জানে না তারা কার জন্য কনটেন্ট তৈরি করছে, অথচ সেই অজানা “দর্শক”-এর মন জয় করতে করতে নিজের মনকে হারিয়ে ফেলে। ৩. অভিভাবক ও শিক্ষকের উদাসীনতা: অনেক সময় অভিভাবক বা শিক্ষক নিজেরাও প্রযুক্তি আসক্ত। ফলে তরুণদের দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হন। স্কুল-কলেজেও প্রযুক্তি নিয়ে সচেতনতা বা ভারসাম্যের পাঠ খুব কম দেওয়া হয়। ৪. অনির্দেশিত ভবিষ্যৎ ও বাস্তব জীবনের হতাশা: চাকরির অনিশ্চয়তা, পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব—এসব থেকে পালাতে গিয়ে প্রযুক্তিকে আশ্রয় হিসেবে দেখা হয়। বাস্তব জীবনের অসন্তুষ্টি থেকে মুক্তি পেতে তরুণরা ডিজিটাল জগতে আশ্রয় খোঁজে। সম্ভাবনার দ্বারও রয়েছে প্রযুক্তিতে:ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার যদি সঠিকভাবে করা যায়, তবে তা তরুণদের জন্য হতে পারে এক বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র।অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে নতুন কিছু শেখা যেমন প্রোগ্রামিং, ডিজাইন, ভাষা ইত্যাদি।ইউটিউব বা ব্লগিং-এর মাধ্যমে নিজের প্রতিভা তুলে ধরা।ডিজিটাল চিত্রাঙ্কন, ভিডিও এডিটিং, মিউজিক কম্পোজিশন, কবিতা পাঠ—এসব এখন ঘরে বসেই করা সম্ভব।উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং বা সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে। তবে এই সবই সম্ভব তখনই, যখন প্রযুক্তিকে আমরা একটি সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করব—আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতার সঙ্গে। কীভাবে ভারসাম্য আনা যায়? ১. স্ক্রিন টাইম সীমিত করার জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ করা। ২. অন্তত একদিন “ডিজিটাল ডিটক্স” পালন করা—যেদিন শুধুমাত্র অফলাইন কার্যকলাপে সময় দেওয়া হবে। ৩. পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়া। ৪. স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিয়ে ওয়ার্কশপ বা ক্লাস অন্তর্ভুক্ত করা। ৫. ব্যক্তিগতভাবে বই পড়া, লিখা, সৃজনশীলতা চর্চায় মনোনিবেশ করা।
তরুণ প্রজন্মের অবসরকে সত্যিকার অর্থে অর্থবহ করতে হলে প্রয়োজন প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীলতা। আমাদের উচিত অবসর মানে কেবল বিনোদন নয়—বরং সৃজন, সংযোগ ও নিজেকে চেনার সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা।ডিজিটাল অবসর যেন এক নিরব বিষাদ হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে। ডিজিটাল নির্ভরতা কমাতে হবে, কিন্তু প্রযুক্তির সম্ভাবনাকেও সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা যাবে না।যদি আমরা তরুণদের এমন একটি পরিবেশ দিতে পারি, যেখানে তারা ভারসাম্য বজায় রেখে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিখবে—তবে ডিজিটাল অবসর হবে না চাপা মন, বরং হবে নতুন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ডেল্টা টাইমস/সাদিয়া সুলতানা রিমি/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |