ভারত-পাকিস্তান অশনি সংকেত: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও করণীয়
রহমান মৃধা:
প্রকাশ: বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫, ৩:১২ পিএম

ভারত-পাকিস্তান অশনি সংকেত: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও করণীয়

ভারত-পাকিস্তান অশনি সংকেত: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও করণীয়

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অঙ্গন আবারও উত্তপ্ত। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে স্নায়ুযুদ্ধ-সদৃশ পরিস্থিতি, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ড্রোন হামলা, বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার জোয়ার, এবং এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে করিডোর চাওয়ার আন্তর্জাতিক চাপ—সব মিলিয়ে এক অস্থির সমীকরণ তৈরি হয়েছে।

এই অস্থিরতার মাঝে বাংলাদেশ পড়েছে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চলছে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া, আর এই ফাঁকে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর নজর পড়েছে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের দিকে। করিডোর ইস্যুতে ভারত বহুদিন ধরেই আগ্রহী, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে বিপরীতমুখী অবস্থানে। আর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকায়, অনেকে এটিকে করিডোর বাস্তবায়নের ‘সুবর্ণ সময়’ হিসেবে দেখছে।

তবে করিডোর প্রশ্নটি শুধু অর্থনৈতিক সুবিধার বিষয় নয়; এটি সরাসরি জড়িত বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ভারসাম্য এবং কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে। ফলে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে চাই সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ও সর্বদলীয় ঐকমত্য।

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকার বদলের পর রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে নতুন উত্তেজনা। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দাবি তুলছে দ্রুত নির্বাচনের, আওয়ামী লীগ চাইছে রাজনীতিতে পুনঃঅংশগ্রহণ, আর ইসলামী দলগুলোও মাঠে সক্রিয়। সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক রাষ্ট্রপতির বিদেশ গমন ও আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেত্রীর গ্রেপ্তার আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে সতর্কভাবে। প্রতিবেশী ভারতও এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে করিডোর ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়গুলো সামনে এনে আলোচনার গতি বাড়াচ্ছে।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ—অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং আন্তর্জাতিক কৌশলগত চাপ সামলে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। বিশেষত যখন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আবহ তৈরি হচ্ছে, তখনই শঙ্কা জাগছে—গণতন্ত্র কি আবারও পরিবারতন্ত্রে পরিণত হবে? আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ছাত্রদের সোচ্চারতা, বিএনপির অভ্যন্তরে নেতৃত্ব হস্তান্তরের ইঙ্গিত, সবকিছু মিলে একটি নতুন শূন্যতা তৈরি করছে—যার পূরণ হতে পারে এক পুরনো মুখচ্ছবিতে: পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতি।

এক ব্যঙ্গাত্মক কিন্তু গভীর বাস্তবতাসংলগ্ন চিত্র কল্পনা করা যায়—তারেক রহমান ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী, তার স্ত্রী স্বাস্থ্য মন্ত্রী, কন্যা পররাষ্ট্র মন্ত্রী, প্রয়াত কোকোর স্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আর রাষ্ট্রপতি বেগম খালেদা জিয়া। যদিও এটি নিছক কৌতুক মনে হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস এই ধাঁচের বিপজ্জনক পুনরাবৃত্তির সাক্ষ্য বহন করে।

এই মুহূর্তে ড. ইউনূসের সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে—দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন, নির্বাচনের রূপরেখা প্রণয়ন—তা ইতিবাচক। তবে এই প্রশাসনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনটি মৌলিক ইস্যুর ওপর:
১) জাতীয় নিরাপত্তা ও করিডোর ইস্যুতে ভারসাম্য রক্ষা,
২) অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন,
৩) আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বার্থ রক্ষা।

এছাড়া, ভারত-পাকিস্তানের সম্ভাব্য সংঘাত গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের যুদ্ধ শুধু সীমান্ত নয়, পুরো অঞ্চলের অর্থনীতি, রাজনীতি ও মানবিক নিরাপত্তাকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেবে। আর এ প্রেক্ষাপটে ভারতের দ্বিচারিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যুতে কথা বলে, অথচ নিজেদের ভেতরেই মুসলমান জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার—নাগরিকত্ব আইন, দাঙ্গা, রাষ্ট্রীয় ঘৃণার রাজনীতির মাধ্যমে। এই দ্বিমুখী নীতি শুধু প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ককেই জটিল করে না, বরং ভারতের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক কাঠামোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এই অস্থির সময়ে বাংলাদেশের করণীয় একটিই—দায়িত্বশীল কূটনৈতিক কৌশল ও সর্বদলীয় ঐক্য। আঞ্চলিক অশান্তির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে কৌশলগত সমন্বয় বজায় রাখা আরও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এখনকার প্রতিটি সিদ্ধান্তের ওপর। এই মুহূর্তে ভুল করলে তার পরিণতি বহন করতে হবে দীর্ঘকাল।

লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

ডেল্টা টাইমস্/রহমান মৃধা/সিআর

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com