রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশিত পথে কোরবানি
মোঃ মাসুদ চৌধুরী
|
.
১। কুরবানির পশুর বৈশিষ্ট্য কুরবানীর পশু সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা শুধুমাত্র পূর্ণবয়স্ক পশু কুরবানি করো; তবে যদি তেমন কিছু না পাও, তাহলে ছয় মাস বা তার কিছু বেশি বয়সের ভেড়াও কুরবানি করতে পারো।’- (সহিহ মুসলিম, ১৯৬৩) ফিকহ অনুযায়ী, গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে ২ বছর, ছাগল, দুম্বা ও ভেড়ার ১ বছর, আর উটের বয়স হতে হবে ৫ বছর। তবে, শুধুমাত্র ভালো গঠনের ছয় মাস বয়সী দুম্বা বা ভেড়া, যেগুলো দেখতে এক বছর বয়সী মনে হয়—সেগুলো কুরবানির জন্য ব্যতিক্রমভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। অন্যদিকে, উবাইদ ইবনে ফাইরূয (রাঃ) বলেন, আমি বারাআ ইবনে আযিব (রাঃ) কে বললাম, রাসূলুল্লাহ (সা.) যে ধরনের পশু কোরবানী করতে অপছন্দ অথবা নিষেধ করেছেন সেই সম্পর্কে আমাদের বলুন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর হাতের ইশারায় বলেন, এরূপ, আর আমার হাত তাঁর হাতের চেয়ে ক্ষুদ্র। চার প্রকারের পশু কোরবানী করলে তা যথেষ্ট হবে না। অন্ধ পশু যার অন্ধত্ব সুস্পষ্ট, রুগ্ন পশু যার রোগ সুস্পষ্ট, খোঁড়া পশু যার পঙ্গুত্ব সুস্পষ্ট এবং কৃশকায় দুর্বল পশু যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে। উবাইদ (রাঃ) বলেন, আমি ক্রটিযুক্ত কানবিশিষ্ট পশু কোরবানী করা অপছন্দ করি। বারাআ (রাঃ) বলেন, যে ধরনের পশু তুমি নিজে অপছন্দ করো তা পরিহার করো, কিন্তু অন্যদের জন্য তা হারাম করো না। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩/৩১৪৪) ২। কোরবানির শরিকের সংখ্যা জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে হুদাইবিয়ার বছরে এক উট সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করতাম এবং এক গরু সাতজনের পক্ষ থেকে। (সহীহ মুসলিম, ১৩১৮)। অন্য হাদিসে, আবূ আইউব আল-আনসারী (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সা.)-এর যুগে একজন ব্যক্তি নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কুরবানী করতেন। তা থেকে সবাই খেত এবং অন্যদেরও খাওয়াতেন। পরবর্তীতে মানুষ কুরবানিকে অহংকারের বিষয় বানিয়ে ফেলেছে।‘ (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩১৪৭)। এছাড়া, আনাস (রাঃ)বলেন, নবী (সা.) দু’টি সাদা-কালো রং এর শিং ওয়ালা ভেড়া (একটি নিজের পক্ষ থেকে এবং অন্যটি তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে) কুরবানী করেন। তিনি ভেড়া দু’টির পার্শ্বে তাঁর পা রেখে ’বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে স্বহস্তেসেই দু’টিকে যবেহ করেন। ‘ (সহিহ বুখারি, ৫৫৬৫; সুনান ইবনু মাজাহ, ৩১২২) ৩। কোরবানির সময় বরা ইবনু আযিব (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আজকের দিনে (১০ই জিলহজ) আমাদের প্রথম কাজ হলো ঈদের সালাত আদায় করা, এরপর ফিরে এসে কুরবানী করা। যে ব্যক্তি এভাবে করেছে, সে আমাদের সুন্নত অনুসরণ করেছে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের আগে কুরবানী করেছে, সে শুধু পরিবারের জন্য মাংস প্রস্তুত করল— সেটি কুরবানী নয়।‘ (সহীহ বুখারী, ৫৫৪৫)
৪। কোরবানির স্থান আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদের দিন নামাজের পরে ঈদগাহে কুরবানির পশু যবাই করতেন।‘ (সহীহ বুখারী, ৫৫৫২)। ঈদগাহে কোরবানি করাটাই উত্তম, কারণ এটি নবীর সুন্নাহ ও সমাজে ঐক্য বৃদ্ধি করে। তবে যদি সেটি সম্ভব না হয়, তাহলে বাসার আশেপাশে পরিচ্ছন্ন জায়গায় করাও মাকরূহ বা হারাম নয়, বরং জায়েজ ও গ্রহণযোগ্য। (ফিকহুস সুন্নাহ, মুয়াল্লিমুল ফিকহ) ৫। কুরবানির পদ্ধতি ও সদয় আচরণ রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরবানির পশু নিজ হাতে যবেহ করতেন, পশুটিকে পার্শ্বদেশে শুইয়ে পা দিয়ে চেপে ধরতেন, এবং যবেহের সময় বলতেন: ‘বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার’। (সহীহ বুখারী, ৫৫৫৮)। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়ে কুরবানি করানো জায়েয, তবে মালিকের পক্ষ থেকে নিয়ত ও ‘বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার’ বলা আবশ্যক। (সহীহ তিরমিজি, ১৫২১) তাছাড়া, কুরবানির সময় পশুর প্রতি সদয় হওয়া, তাকে ভয় না দেখানো এবং যন্ত্রণাহীনভাবে যবেহ করা ইসলামের সুন্নত ও নির্দেশ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘যখন তোমরা যবেহ করো, ভালোভাবে যবেহ করো। তোমাদের কেউ যেন তার ছুরি ধারালো করে নেয় এবং পশুকে কষ্ট না দিয়ে আরাম দেয়।‘ (সহিহ মুসলিম: ১৯৫৫) ৬। কুরবানির গোশত, চামড়া ও আনুষঙ্গিক জিনিস সদকা করা যাবে, কসাইকে পারিশ্রমিক দেওয়া যাবে না ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ) ..... আলী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তার কুরবানীর উটগুলোর নিকট দাঁড়াতে এবং এগুলোর মাংস, চামড়া ও ঝুল দান খয়রাত করে দিতে নির্দেশ দিলেন এবং তা দিয়ে কসাইয়ের মজুরি দিতে নিষেধ করলেন এবং বললেনঃ আমাদের নিজেদের পক্ষ থেকে তার মজুরি পরিশোধ করে দেব। (সহীহ মুসলিম, ৩০৭১-(৩৪৮/১৩১৭)) ৭। কুরবানীর মাংস খাওয়া, বণ্টন ও সংরক্ষন প্রিয় নবী (সা.) কুরবানীর মাংস তিন দিনের বেশি রাখার ব্যাপারে প্রথমে নিষেধ করেছিলেন, কারণ তখন অনেক দরিদ্র বেদুঈন শহরে এসেছিল, যাতে সবাই দান করে তাদের সাহায্য করে। পরে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো, তিনি বললেন: এখন তোমরা ইচ্ছামতো খেতে পারো, সংরক্ষণ করতে পারো এবং দানও করতে পারো। (সহীহ মুসলিম, ৪৯৪২) ৮। যিলহজ্জের প্রথম দশদিনে নখ ও চুল না কাটা উম্মু সালামা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি যিলহজ্জ মাসের নতুন চাঁদ দেখে এবং কোরবানী করার ইচ্ছা রাখে, সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে। (সহীহ মুসলিম, ১৯৭৭; সুনান ইবনু মাজাহ,২/৩১৫০)
ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের অন্তরে লুকিয়ে থাকে একটি গভীর আত্মিক বার্তা ও সামাজিক নির্দেশনা। কোরবানি তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করে সঠিক নিয়মনীতি মেনে কোরবানি আদায় করাই একজন মুসলিমের কর্তব্য। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করে তা সঠিকভাবে পালন করার তাওফিক দান করেন — আমিন। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |