বিদায় হজের ভাষণ : মানবতার চূড়ান্ত বার্তা
রেহানা ফেরদৌসী:
|
. বিদায় হজ: পটভূমি ও তাৎপর্য হিজরি ১০ সালের জিলহজ মাসে মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের একমাত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সাহাবিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই হজে তাঁর সঙ্গে ছিলেন। ইতিহাসবিদদের মতে, তখনকার আরাফার ময়দানে ১ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। এই হজ ইতিহাসে “বিদায় হজ” নামে পরিচিত—কারণ এই হজের কিছুদিন পরই মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেন এবং এই হজের ময়দানেই তিনি তাঁর জীবনের শেষ ও সর্বজনীন ভাষণ প্রদান করেন, যেটি ইসলামের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সারাংশ হয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা এই ঐতিহাসিক ভাষণের সময় নাজিল হয় কুরআনের আয়াত (সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত ৩):
এই আয়াত ইসলামের পরিপূর্ণতা এবং মানবতার প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের প্রতিফলন। ভাষণের কেন্দ্রীয় বার্তা: সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে,
এই ঘোষণাটি ছিল মানব ইতিহাসে এক বিপ্লবী বার্তা, যেখানে বংশ, জাতি, বর্ণ ও ধনসম্পদের ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে চিরতরে অস্বীকার করা হয়। আধুনিক মানবাধিকার সনদ যে নীতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে, তা এই ভাষণের মধ্যেই বিদ্যমান। নারীর অধিকার ও মর্যাদা বিদায় হজে মহানবী (সা.) নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার এবং তাঁদের অধিকার সম্পর্কে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন:
সেই সময়ের আরব সমাজে নারীরা ছিল অবহেলিত ও নির্যাতিত। ইসলাম নারীদের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও সম্পদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে তাদের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়—যার সূচনা এই ভাষণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে হয়। অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার: সুদ নিষিদ্ধ ঘোষণামহানবী (সা.) তাঁর ভাষণে সুদের কঠোর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন:
এটি কেবল একটি ধর্মীয় নির্দেশই নয়; বরং সমাজে অর্থনৈতিক শোষণ, বৈষম্য ও সম্পদ-সংকেন্দ্রণের বিরুদ্ধে একটি প্রগতিশীল পদক্ষেপ। সুদের নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সমাজে ধনী-গরিবের ব্যবধান কমানো এবং অর্থনীতিতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামের স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরা হয়। প্রাণ ও সম্পদের নিরাপত্তা মহানবী (সা.) বলেন:
এই ঘোষণার মাধ্যমে ব্যক্তির জীবন, সম্পদ এবং মান-সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গঠনে এ নীতি অপরিহার্য। ঐক্য ও বিভেদের বিরুদ্ধে বার্তা বিদায় হজের ভাষণে মুসলিম উম্মাহকে বিভেদ, বিদ্বেষ এবং হিংসা থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি বলেন:
আজকের বিশ্বে জাতিগত সংঘাত, ধর্মীয় বিভাজন, গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে এই ভাষণ এক অনন্য শিক্ষণীয় বার্তা। প্রতিটি যুগে প্রাসঙ্গিক একটি শিক্ষা বিদায় হজের ভাষণ এক হাজার চারশ বছর আগে প্রদত্ত হলেও, তার বিষয়বস্তু আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আধুনিক যুগে যখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, নারীর অধিকার খর্ব হচ্ছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে এবং ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে—তখন এই ভাষণ আমাদের সামনে একটি আদর্শ পথনির্দেশনা হিসেবে কাজ করতে পারে। শেষ সময়ে মহানবীর সাক্ষ্য গ্রহণ এই মহান ভাষণের শেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত সবাইকে জিজ্ঞেস করেন:
তখন তিনি তিনবার বলেন: এটি শুধু একজন নবীর দায়িত্ব সম্পাদনের ঘোষণা নয়, বরং মানবজাতির প্রতি তাঁর চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা, যেটি তাঁর উম্মতের কাছে আমানত হিসেবে রয়ে গেছে। বিদায় হজের ভাষণ ছিল না শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উপদেশ; এটি ছিল মানবজাতির মুক্তির সার্বজনীন ঘোষণা। এতে সাম্য, শান্তি, সম্প্রীতি, সামাজিক ন্যায়বিচার, নারী-পুরুষের মর্যাদা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার চূড়ান্ত বার্তা প্রদান করা হয়েছে। এই ভাষণ প্রতিটি মুসলমানের জন্য যেমন আদর্শ, তেমনি প্রতিটি মানবাত্মার জন্য একটি মানবিক সংবেদনশীলতার শিক্ষা। আমরা যদি এই ভাষণের আলোকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে গড়ে তুলি—তবে শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও কল্যাণমুখী পৃথিবী গঠন সম্ভব। আল্লাহ যেন আমাদের এই মহান ভাষণের মূল শিক্ষা অনুসরণ করে জীবন পরিচালনার তৌফিক দেন। আমিন। লেখক: সহ সম্পাদক,সমাজকল্যাণ বিভাগ, পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক)। ডেল্টা টাইমস/রেহানা ফেরদৌসী/সিআর |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |