গাজার আগুনে প্রতিফলিত জাতির মুখ: ইতিহাস বনাম মানবতা
জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫, ১০:৫৫ এএম

গাজার আগুনে প্রতিফলিত জাতির মুখ: ইতিহাস বনাম মানবতা

গাজার আগুনে প্রতিফলিত জাতির মুখ: ইতিহাস বনাম মানবতা

গাজা এখন আর শুধু একটি ভূখণ্ডের নাম নয়—এটি এক রক্তাক্ত দলিল, একটি জাতির নীরব চিৎকার, সভ্যতার বিবেকহীনতার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধ, হাসপাতালের বেডে শিশুদের নিথর দেহ, মায়ের শূন্য কোল, আর চারপাশে ধ্বংসস্তূপ। বিশ্ব তাকিয়ে আছে—নির্বাক, নিষ্ঠুর, নীচ।

একদা জার্মান নাৎসি বর্বরতার কবল থেকে পালিয়ে নিরাপত্তার খোঁজে ছুটে বেড়ানো ইহুদি জাতি ইউরোপে ঠাঁই পায়নি। ইতিহাস তাদের চিহ্নিত করেছিল ‘শিকার’ হিসেবে। ৬০ লক্ষ ইহুদি যখন গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুবরণ করছিল, তখনও বিশ্ব নীরব ছিল। সেই নীরবতার ফলেই জন্ম নেয় একটি রাষ্ট্র—ইসরায়েল।

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ইসরায়েল গড়ে ওঠে আরেক জাতিকে ঘরছাড়া করে। ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে, শত শত গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে, লাখো মানুষকে উদ্বাস্তু করে গঠিত হয় এ রাষ্ট্র। ইতিহাস একে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আজ, সেই বিপর্যয়ের ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে ইসরায়েল ফের ইতিহাসের কলঙ্ক রচনা করছে।

যে জাতি একদিন গ্যাস চেম্বারে বন্দি ছিল, তারা আজ এক জনপদকে পরিণত করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খোলা বন্দিশালায়। গাজার ২৩ লক্ষ মানুষ অবরুদ্ধ, অব্যাহত বোমাবর্ষণ, ক্ষুধা, বিদ্যুৎ ও পানির সংকটে দিন কাটাচ্ছে। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা প্রায় ৫৭ হাজার, যার মধ্যে অন্তত ১৪,৫০০ শিশু। প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন শিশু মারা যাচ্ছে—এই সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, মানবতার বিবেকে এক বিস্ফোরণ।

আর এই গণহত্যা চলছে “আত্মরক্ষার অধিকার” নামক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ভণ্ডামির ছায়ায়। প্রশ্ন হলো—কার বিরুদ্ধে এই আত্মরক্ষা? যাদের হাতে অস্ত্র নেই, পানির গ্যালন পর্যন্ত নেই, যারা স্কুলে গিয়ে আর ফিরে আসে না? আত্মরক্ষার নামে স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ এমনকি শরণার্থী শিবিরেও বোমা বর্ষণ হচ্ছে।

বিশ্ববিবেক আজও নিঃশব্দ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সভা ডাকা হয়, অথচ গাজার জন্য শুধুই ‘উদ্বেগ’ বরাদ্দ থাকে।

জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে ‘গণহত্যার সম্ভাব্য প্রেক্ষাপট’ বলে আখ্যা দিলেও কার্যত কেউই থামানোর উদ্যোগ নিচ্ছে না। অথচ গণহত্যার সংজ্ঞা স্পষ্ট—যখন একটি জাতিকে পরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলে, তখনই তা গণহত্যা।

আজকের ইসরায়েল কোনো ধর্মের প্রতীক নয়, বরং এক রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের বাস্তব রূপ। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে একের পর এক যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, যুদ্ধবিরতির তোয়াক্কা করা হয়নি। তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও মানবিক পশ্চিমা বিশ্ব চোখ বুজে আছে—কারণ তাদের অস্ত্র ব্যবসা আর কূটনৈতিক মিত্রতা।

তবু, অন্ধকারের মাঝে কিছু কণ্ঠস্বর জেগে ওঠে। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, টোকিও—বিশ্বজুড়ে ইহুদি ও অ-ইহুদি তরুণেরা রাস্তায় নেমে বলছে: “Not In Our Name!”—ইসরায়েল আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। এই প্রতিরোধ প্রমাণ করে, বিবেক এখনো মরে যায়নি—যদিও তা নিঃস্ব ও নিঃশব্দ।

ইতিহাস একদিন বিচার করে। হিটলার ছিলেন না চিরস্থায়ী, নাৎসি পতাকা আজ জাদুঘরে। ইসরায়েলি দখলদারিত্বও একদিন দাঁড়াবে ইতিহাসের কাঠগড়ায়। সেদিন ইহুদি জাতি হয়তো বুঝবে—শিকার থেকে শিকারি হয়ে ওঠা কখনো গৌরব নয়, বরং তা ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিকৃতি।

গাজার শিশুদের চোখে যে অগ্নিস্নান, তা কোনো রকেট প্রতিহত করতে পারে না। তা অন্তর্দৃষ্টি বিদীর্ণ করে দেয়। যদি বিশ্ব এই সত্যকে অস্বীকার করে, তবে মানবতা নামক নৈতিক অবস্থান আমরা হারিয়ে ফেলব। কারণ, এই যুদ্ধ কেবল ভূমির নয়—এটি মানবতার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।

লেখক : শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর।

ডেল্টা টাইমস/জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com