|
অফলাইন বন্ধুত্বের মৃত্যু, অনলাইনের জগতে জেন জি
সাদিয়া সুলতানা রিমি:
|
![]() অফলাইন বন্ধুত্বের মৃত্যু, অনলাইনের জগতে জেন জি এক সময় বন্ধুত্ব মানে ছিল মুখোমুখি বসে গল্প করা, একসঙ্গে সময় কাটানো বা ছোটখাটো মুহূর্ত ভাগাভাগি করা। আজ সেই বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বদলে গেছে। এখন বন্ধুত্বের মানদণ্ড নির্ধারিত হয় “ফলোয়ার সংখ্যা” বা “লাইক”-এর পরিমাণ দিয়ে। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে পাওয়া প্রশংসা অনেক সময় বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়। জেন জি প্রজন্ম এই ডিজিটাল বন্ধুত্বে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেলেও সাথে এসেছে এক ভয়াবহ মানসিক চাপ—সর্বদা নিখুঁত দেখানোর চেষ্টা, জনপ্রিয় থাকার দৌড়, এবং অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের জীবন তুলনা করার অভ্যাস। এই প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়াকে আত্মপ্রকাশের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে। তারা নিজেদের চিন্তা, ফ্যাশন, সৃজনশীলতা কিংবা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সেখানে তুলে ধরে। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, পরিচিতি মেলে, কিন্তু ধীরে ধীরে এটি এক ধরনের সামাজিক প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়। যখন ‘লাইক’ বা মন্তব্য প্রত্যাশিত হয় না, তখন তারা নিজের মূল্য নিয়েই সন্দেহে পড়ে। এর ফলে জন্ম নেয় আত্মবিশ্বাসের সংকট, হতাশা এবং মানসিক উদ্বেগ। অনেকে অন্যের রঙিন ছবির সঙ্গে নিজের বাস্তব জীবনের তুলনা করে নিজের জীবনকে ব্যর্থ মনে করে। এই অদৃশ্য চাপ তাদের মধ্যে বিষণ্নতা ও একাকিত্বের অনুভূতি সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব অনেক সময় উপরিভাগে সীমাবদ্ধ থাকে। সেখানে হাসি, ইমোজি বা একটুখানি “কমেন্ট” দিয়ে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। গভীর আবেগ বা সহানুভূতির জায়গা থাকে না। একজন তরুণ হয়তো হাজার হাজার ফলোয়ারের মালিক, কিন্তু মন খারাপের সময় পাশে বসে কথা বলার মতো একজনও নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা অতিরিক্ত সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করে, তাদের মধ্যে একাকিত্ব ও বিষণ্নতার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। সংযোগের বাহুল্যেও তারা আসলে বিচ্ছিন্নতার গভীরে ডুবে যায়। সোশ্যাল মিডিয়া জেন জির মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। প্রতিদিন নিরন্তর তথ্য, ছবি ও ভিডিওর বন্যায় তাদের মনোযোগ বিভ্রান্ত হয়। প্রতিনিয়ত নতুন নোটিফিকেশন, লাইক বা কমেন্টের প্রত্যাশা এক ধরনের “ডোপামিন আসক্তি” তৈরি করে, যেখানে মস্তিষ্ক সাময়িক আনন্দে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই উদ্দীপনা কমে গেলে আসে মানসিক ক্লান্তি ও শূন্যতা। আজকাল তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ, আত্মসম্মানহানি ও নিদ্রাহীনতা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচক দিকও অস্বীকার করা যায় না। এই প্ল্যাটফর্মই জেন জিকে দিয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের সুযোগ এবং নতুন ধরনের সচেতনতা। জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার, মানবাধিকার বা রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের মতো বিষয়গুলোতে জেন জি অনলাইনে সংগঠিত হচ্ছে, মত দিচ্ছে, এবং বিশ্বজুড়ে সচেতনতা তৈরি করছে। তবে এই সচেতনতার মধ্যে অনেক সময় “ক্লিকটিভিজম” নামের এক ভ্রান্ত বাস্তবতা তৈরি হয়—যেখানে বাস্তব পদক্ষেপের বদলে শুধু লাইক-শেয়ার দিয়েই দায়িত্ব শেষ মনে করা হয়। এতে ভাবনার গভীরতা কমে যায় এবং সক্রিয় নাগরিকত্ব সীমিত হয়ে পড়ে ভার্চুয়াল আওয়াজের মধ্যেই। পারিবারিক সম্পর্কেও এই প্রভাব স্পষ্ট। এক সময় পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে কথা বলত, গল্প করত বা টিভি দেখত। এখন প্রত্যেকে নিজ নিজ স্ক্রিনে ডুবে থাকে। বাবা-মা সন্তানদের জীবন সম্পর্কে জানেন না, সন্তানরাও বাস্তব কথোপকথনের চেয়ে মেসেঞ্জার চ্যাটকে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য মনে করে। ফলে প্রজন্মের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে, পারিবারিক যোগাযোগ দুর্বল হচ্ছে, এবং একাকিত্বের বোধ আরও গভীর হচ্ছে। তবে এই বাস্তবতা পরিবর্তন করা অসম্ভব নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া নয়, বরং এর ব্যবহারকে সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করাই সমাধান। তরুণদের উচিত নিজেদের সময়ের সঠিক বণ্টন শেখা—এক নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার না করা, অফলাইনে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, বই পড়া, খেলাধুলা বা শখের কাজ করা। অভিভাবকদেরও দায়িত্ব সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা সম্পর্ক তৈরি করা এবং তাদের ভার্চুয়াল জীবনের প্রতি আগ্রহ দেখানো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিজিটাল ওয়েলবিয়িং বা মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষা চালু করা প্রয়োজন, যাতে তরুণরা অনলাইনের ইতিবাচক দিক কাজে লাগাতে পারে এবং নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। শেষ পর্যন্ত, সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে, কিন্তু সেটি যেন আমাদের মানবিকতা কেড়ে না নেয়। ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের জগতে সংযোগ যতই গভীর হোক না কেন, বাস্তব সম্পর্কের উষ্ণতা তার বিকল্প হতে পারে না। জেন জি প্রজন্মের সামনে আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ডিজিটাল জীবনের সঙ্গে মানবিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা। যদি তারা এই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে পারে, তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হবে তাদের আত্মপ্রকাশের শক্তি, একাকিত্বের শৃঙ্খল নয়। কারণ শেষ পর্যন্ত, মানুষ কেবল সংযুক্ত থাকতে চায় না—সে চায় সত্যিকারের সম্পর্ক, যেখানে অনুভূতির আদান-প্রদান হয় হৃদয়ের গভীরতা থেকে, স্ক্রিনের পিক্সেল নয়। লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ডেল্টা টাইমস্/সাদিয়া সুলতানা রিমি/আইইউ |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |