|
গাজার গনহত্যা মুসলিম বিশ্বের জন্য বড় বার্তা
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() গাজার গনহত্যা মুসলিম বিশ্বের জন্য বড় বার্তা গত দুই দশক ধরে এখানকার ভূ-রাজনীতির যে উত্তেজনাকর চিত্র, তার একদিকে ইরান এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা। ইরানের এই নেটওয়ার্কের মূলে, যেটা কখনো পরিচিত প্রতিরোধের জোট হিসেবে, সেই দলে রয়েছে লেবাননের হেজবুল্লাহ, সিরিয়ার আসাদ সরকার, ইয়েমেনের হুতি এবং ইরাকের সশস্ত্র বাহিনী যাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ইরান। ইরানিরা গাজায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদকেও সমর্থন দিয়ে আসছে। একইসাথে ইরান এখন চীন এবং রাশিয়ারও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ইউক্রেনে রাশিয়া যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে ইরান সেটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর চীন ইরানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ তেল কিনে থাকে। গাজায় যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে এবং ইসরায়েল যত বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোক হত্যা করবে ও হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করবে, ততই এই দুই মিত্র গোষ্ঠীর কোন কোন সদস্যের মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হবে। ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর গণহত্যা চালানোর প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করেছে, এ সত্য এখন স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান।আলজাজিরার খবরে প্রকাশ, ইসরায়েল প্রতিরক্ষা নীতি শিথিল করে সেনাবাহিনীকে গাজায় স্থল অভিযানের অংশহিসেবে যে কাউকে হত্যা করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে। ইসরায়েলের রাজনীতিবিদ ও সেনারা প্রকাশ্যে গাজাকে ভূপাতিত করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বিলুপ্ত করার কথা বলাবলি করছে; গাজার ভূমিতে ইসরেয়েলি অভিবাসীদের আবাস স্থাপনের সুখকল্পনায় লিপ্ত। ফিলিস্তিনিরা খাদ্য, পানীয় জল, আশ্রয় ও চিকিৎসা সেবার মতো বেঁচে থাকার সব আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ থেকে বঞ্চিত; নির্বিবাদে আকাশ থেকে বোমা নেমে এসে ফিলিস্তিনকে বিকলাঙ্গ করে দিচ্ছে। গণহত্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ব্যাপক নাশকতা কোনো উগ্রবাদী রাজনৈতিক গোত্রে’র প্রভাবে হচ্ছে না; বরং সবচেয়ে ভীতিকর হলো,গণহত্যাটি হচ্ছে সমর্থকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে, নীরবে। কোনো গণহত্যার প্রতি এমন প্রকাশ্য ও সক্রিয় সমর্থন এর আগে দেখা গিয়েছে কিনা, তা জানা নেই, তবে উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের নানা প্রতিষ্ঠান একে হয় সক্রিয় সমর্থন দিচ্ছে অথবা এ বিষয়ে পুরোপুরি নীরবতা পালন করছে, যা সমর্থনেরই নামান্তর। একটি গণহত্যা সংঘটিত হতে হলে দুটো জিনিস প্রয়োজন: গণহত্যা চালানোর অবকাঠামোগত ও বস্তুগত সামর্থ্য এবং গণহত্যাকে গণহত্যা না বলে অন্য কোনো নাম দিয়ে দেওয়া। পশ্চিমা বিশ্ব এই দুই ক্ষেত্রেই সমানভাবে অংশ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র একটি নয়, দু-দুটি বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছে ওই অঞ্চলে এবং স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, কোনো রাষ্ট্র বা দল এর মধ্যে ঢুকলে তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করা হবে। যুক্তরাজ্যও নৌবহর পাঠিয়ে এই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদে মদদ দিচ্ছে। আমেরিকা ইসরায়েলে প্রতিরক্ষা উপাদান ও অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে, যুদ্ধবিরতির আহ্বান খারিজ করছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে সাহায্য করার নামে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মিসরকে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে উদ্বুদ্ধ করছে যেন তারা আর গাজায় ফিরে যেতে না পারে। বছরের পর বছর এসব সহায়তাই ইসরায়েলকে গণহত্যা পরিচালনার জন্য সক্ষম করে তুলেছে। গণহত্যাকে আড়াল করার জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে বলা হচ্ছে, দুনিয়াজুড়ে ইহুদিদের নিপীড়নের বিপরীতে এটি একটি বৈধ লড়াই। ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে চাকরি হারাচ্ছেন, অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন অনেকে। সব ধরনের প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো সর্বশক্তিতে বলে যাচ্ছে, ফিলিস্তিনের নাগরিক জীবন ধ্বংস করার জন্য দায়ী হামাসই। ইসরায়েলের এ অভিযানকে দেখা হচ্ছে হামাস নির্মূল অভিযান হিসেবে। যারা এ বয়ানের বিরোধী, তাদেরই কোণঠাসা করা হচ্ছে; মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সংক্ষেপে বললে, পশ্চিমা সব প্রতিষ্ঠান এ মুহূর্তে সভ্যতাকে বর্বরতা থেকে বাঁচানোর নামে ফিলিস্তিনে চলমান গণহত্যা সংঘটনে সংগঠিত মদদ দিচ্ছে। ফিলিস্তিনে ইতোমধ্যে যা ঘটেছে তার ব্যাপ্তি ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর এবং যা ঘটবে তা হবে আরও বীভৎস। এরকম সময়ে কোনো কিছুই অস্পষ্ট থাকে না। আমাদের অনেকের কাছেই এটি দীর্ঘদিন আগে থেকেই পরিষ্কার ছিল কিন্তু এখন আর সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এ সময়ে এসে পনেরশ শতকের মতো দখলদারি চালাচ্ছে। হ্যাঁ, এর প্রক্রিয়া, কৌশল, নীতি এবং শক্তি ও ক্ষমতার রূপান্তর ঘটেছে।কুশীলব পাল্টেছে, কিছু বিষয় জটিলতর হয়েছে, কিছু জটিলতা অবশ্য কমেছে। এভাবেই চলছে।এসব তাত্ত্বিক আলোচনা জরুরি বটে, কিন্তু এ মুহূর্তে নয়। এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, এসব কথা স্পষ্টভাবে উচ্চ স্বরে বলা-সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, ক্ষমতা ও সম্পদের লালসায় সব সময়ের মতোই লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যাচ্ছে।অপরদিকে ইসরায়েল আর লেবাননের সীমান্তে ধীরে ধীরে উত্তেজনা দানা বাঁধছে। ইসরায়েল বা হেজবুল্লাহ কোন পক্ষই অবশ্য সরাসরি যুদ্ধ চায় না।কিন্তু যেহেতু দু'পক্ষ থেকেই উত্তজনা ক্রমে বেড়ে চলেছে, তাই সেটা কোন এক সময় অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ার ঝুঁকিটাও তৈরি হয়। ইয়েমেনের হুতিরা ইসরায়েলের দিকে তাক করে মিসাইল ও ড্রোন হামলা ছুঁড়েছে। যদিও সবপক্ষই উত্তেজনা যাতে খুব বেশি না ছড়ায় সেই চেষ্টা করছে, কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সবসময়ই কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আছে ইসরায়েল, উপসাগরীয় তেল সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলো, জর্ডান ও মিশর। যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই ইসরায়েলকে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে, যদিও এটা পরিষ্কার যে ইসরায়েল যে ব্যাপক পরিমাণে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক হত্যা করছে সেটা নিয়ে অস্বস্তি আছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনেরও। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন প্রকাশ্যেই বলেছেন যে অনেক বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছে। উত্তর গাজা থেকে হাজারে হাজার ফিলিস্তিনের পালিয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে হেঁটে দক্ষিণে যাওয়ার যে দৃশ্য সেটা অনেককেই ১৯৪৮ সালে আরবদের বিপক্ষে ইসরায়েলের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যে সাত লাখেরও বেশি মানুষ ইসরায়েলি বাহিনীর অস্ত্রের মুখে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে সেটাকে ফিলিস্তিনিরা আল নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের সঙ্গেও তুলনা করছে। সেই ১৯৪৮ সালের শরণার্থীদের পরের প্রজন্মের বেশিরভাগই এখন গাজা উপত্যকার বাসিন্দা। আর কিছু উগ্র ইহুদী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, যারা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমর্থক, তাদের অনেকের ফিলিস্তিনিদের উপর আরেকটি নাকবা আরোপের মতো ভয়ংকর কথাবার্তা, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র শিবিরেরই কিছু আরব দেশ বিশেষ করে জর্ডান ও মিশরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।এমনকি নেতানিয়াহু সরকারের একজন মন্ত্রী তো হামাসকে মোকাবেলা করার জন্য গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলার ইঙ্গিতও দেন। তাকে তিরস্কার করা হলেও বহিষ্কার করা হয়নি। এসবকে পাগলের আলাপ বলে উড়িয়ে দেয়া যেতে পারে কিন্তু জর্ডান ও মিশরটা বিষয়টা গুরুত্ব সহকারেই নিয়েছে। সেটা অবশ্য পারমাণবিক বোমার ব্যাপারে না হলেও, যেটা ইসরায়েলের ঘোষিত ও অঘোষিত অনেকই আছে, বরং হাজার হাজার ফিলিস্তিনির তাদের সীমানায় ঢুকে পড়ার শঙ্কা তাদের বেশি। আর যদি গাজায় যুদ্ধের কথা বলা হয়, তাহলে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিকরা বিবিসিকে বলেছেন, যুদ্ধ এবং তার পরবর্তি পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হবে খুবই কঠিন এবং বিশৃঙ্খল। একমাত্র রাস্তা হবে ফিলিস্তিনের জন্য একটা রাজনৈতিক দিগন্ত পুন:নির্মান করা। মূলত ইসরায়েলের পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তথাকথিত ‘টু-স্টেট’ সমাধান, যা ব্যর্থ হয়ে এখন শুধু স্লোগানেই টিকে আছে। সেটাকে পুনরুজ্জীবিত করা, ইসরায়েল ও আরবের মধ্য থেকে তাদের জায়গা বের করা খুবই উচ্চভিলাষী পরিকল্পনা এবং একই সাথে সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভালো সমাধানও। কিন্তু বর্তমানে যে বেদনা, ঘৃণা আর শঙ্কার পরিবেশ চলমান সেখানে এই ধারণার প্রয়োগ করা হবে খুবই কঠিন কাজ। আর বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি যে নেতৃত্ব তাদের অধীনে এটা অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ হল দুই রাষ্ট্রের সমাধান নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, যেটি নেতানিয়াহু তার পুরো রাজনৈতিক জীবন জুড়ে বিরোধীতা করে এসেছেন। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার বিপক্ষে শুধু নেতানিয়াহুই নন। তিনি যাদের সমর্থনে আবারও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে এসেছেন সেই গোঁড়া ইহুদী জাতীয়তাবাদী যারা তাদের বিশ্বাস, জর্ডান নদী আর ভূমধ্যসাগরের মাঝখানের যে অঞ্চল সেটা পুরোটাই ইহুদীদের জন্য ঈশ্বরের দান এবং তার ইসরায়েলের সীমানার ভেতরেই থাকতে হবে। ইসরায়েলের ভেতরে অনেকেই ৭ই অক্টোবরের হামলার জন্য নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যর্থতায় নেতানিয়াহুকে দায়ী করে তার পদত্যাগও চাইছেন। একসময় নেতৃত্বের বদল ঘটবে। কিন্তু যদি গাজার এই মর্মান্তিক যুদ্ধ ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও তাদের শক্তিশালী বন্ধুদের শান্তি স্থাপনে বাধ্য না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আরো যুদ্ধই অপেক্ষা করছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যে দেশটির মাতামাতি বিশ্ববাসীকে তটস্থ করে রাখে তাদের ইসরাইল নীতি মুখোশ খোলার জন্য যথেষ্ট বললে খুব একটা ভুল হবে না। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস্/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |