|
কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে মিয়ানমারের জান্তা সরকার
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে মিয়ানমারের জান্তা সরকার সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা বিচ্ছিন্নভাবে সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘাতে জড়িয়েছে। তবে সব সময়ই তারা নিজেদের ভূখণ্ড প্রসারিত করতেই এই সংঘাত করেছে, এনইউজি এর সমর্থনে নয়। প্রায় তিন বছর আগে মিয়ানমারের ওপর যে স্থবির হতাশা নেমে আসে; সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে সামরিক জান্তাবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব বাহিনী ও পদচ্যুত নির্বাচিত নেতাদের নিয়ে দ্য পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) বা নাগরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠিত হয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় পিডিএফ ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। এমনকি তারা এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠছে যে, মিয়ানমারের সামরিক শাসন পতনের দ্বারপ্রান্তে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে। সেখানে সরকার বিরোধী শক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিং দখল করেছে। এর ফলে চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিয়ানমার সামরিক জান্তা। জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার সমন্বয়ের কারণেই এমনটি সম্ভব হয়েছে। তাদের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের ফলে সামরিক শাসন টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। সামরিক জান্তার বাহিনীর সঙ্গে বারবার সংঘর্ষ এবং তাদের ওপর নিয়মিত অতর্কিত হামলায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি যেমন হয়েছে, তেমনি তাদের মনোবলেও চিড় ধরেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ১৩০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি, কৌশলগত ফাঁড়িসহ উল্লেখযোগ্য অঞ্চল দখল করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। এই অ্যালায়েন্স বা জোটের অভিযানে পদাতিক ডিভিশনের এক কমান্ডারের মৃত্যু হয়েছে এবং দুটি ব্যাটালিয়ন আত্মসমর্পণ করেছে। প্রতিরোধ বাহিনী সামরিক সরঞ্জামও জব্দ করেছে। এতে সেখানে বিদ্রোহীদের আন্দোলন আরও জোরদার হয়েছে। এভাবে মিয়ানমারের বিভিন্ন জায়গায় জান্তা বাহিনীর দ্রুত পতন প্রমাণ করছে, মিয়ানমারে দীর্ঘমেয়াদি শাসনে সামরিক বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ছে।বস্তুত, তিন বছর আগে সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। সামরিক শাসনবিরোধী অবস্থান, দুর্নীতি ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের পকেট ভরার ধান্দায় যে অভ্যন্তরীণ সংকট তৈরি হয়েছে; সব মিলিয়ে জান্তা এখন বিপদে। তাদের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মিয়ানমারের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র চিনশওয়েহাওর মতো কৌশলগত শহর হাতছাড়া হওয়ার ফলে রাজস্ব হ্রাস পেয়েছে। চিনশওয়েহাও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হলো, ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের ২ বিলিয়ন ডলারের সীমান্ত বাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি হয়েছে এই শহরের মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এর পাশাপাশি জান্তার প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বিশেষ করে রাজ্য প্রশাসনিক পরিষদও ব্যাপক আর্থিক এবং কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। রাশিয়া, চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ ছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে কেউই জান্তা সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত আর্থিক নিষেধাজ্ঞা এবং বিশ্বব্যাপী তাদের অগ্রহণযোগ্যতার কারণে তাদের রসদ কমে যাচ্ছে এবং প্রশাসনকি অবস্থান আরও দুর্বল হচ্ছে। ঘনীভূত সংকটে তাদের পতন আসন্ন হয়ে পড়েছে। এই মাত্রায় প্রতিরোধ চলতে থাকলে প্রশ্নটি কেবল দাঁড়াবে কখন পতন ঘটছে। স্বাভাবিকভাবেই মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ আলোচনাকে জান্তার পতনের পর সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা কী হবে সেদিকে নিয়ে গেছে। এখানে সমন্বয় করতে হবে এবং নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক দিক থেকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরল এক সহযোগিতা হয়তো আমরা দেখব। মিয়ানমারের স্থিতিশীলতায় চীন তার স্বার্থ সুরক্ষার জন্য শান্তি রক্ষার চেষ্টা করবে। চীন আগে থেকেই শরণার্থীদের আশ্রয়, শান্তি আলোচনার জন্য বিশেষ দূত নিয়োগ এবং রাখাইন রাজ্যের সংকটে মিয়ানমারকে রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু জান্তা সরকারের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক তিক্ত সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। সে জন্য চীন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বিত বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে সরকারবিরোধী শক্তির মধ্যে তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করবে। তবে চীন সেখানেই বসে থাকবে বলে মনে হয় না। দেশটি সম্ভবত সামরিক বাহিনী ও প্রতিরোধ শক্তি উভয়ের মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখবে, যার ফলে দু’পক্ষের ওপর চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।অন্যদিকে চীনের বিরোধিতার কারণে মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আগে থেকেই কম। তবে আমেরিকানরা চীনের প্রভাব কমাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় মিয়ানমারকে রাখতে পারে। সেখানে সামরিক জান্তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে পশ্চিমা বিশ্বের মিয়ানমারের প্রতিরোধ শক্তির সঙ্গে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে; কিংবা বিকল্প হতে পারে, পশ্চিমারা চীনের সঙ্গে মিলে উভয়ের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে পারে। সেটি হলো, অগণতান্ত্রিক সামরিক জান্তাকে পদচ্যুত করা এবং বেইজিংয়ের ইচ্ছা অনুসারে সেখানে স্থিতিশীল সরকার গঠন করা। মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী, পদচ্যুত নির্বাচিত নেতা, কর্মী ও সশস্ত্র প্রতিরক্ষা বাহিনী শাসন করতে পারবে কিনা, কিংবা দেশটি আরও বড় বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার আগে মিয়ানমারের প্রতিরোধ আন্দোলনকে একটি সুযোগ দেওয়া দরকার। অন্যথায় বিশৃঙ্খল বিশ্বের পরবর্তী ক্ষেত্র হয়ে উঠবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইতোমধ্যে যা ছুরির ফলার ওপর বসে আছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স তাদের হামলার সময় খুব সূক্ষ্মভাবে নির্ধারণ করেছে। লাউকাইং শহরে একটি ঘটনায় জান্তা সরকারের উপর থেকে চীন ধৈর্য হারা হওয়ার পর পরই তারা এই হামলা চালিয়েছে। গত বছর চীন সরকার স্ক্যাম সেন্টারগুলো বন্ধ করতে সামরিক সরকারের উপর চাপ দেয়। এই সেন্টারগুলো মূলত চীনের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এসব সেন্টারে আটক পাচার হওয়া ভুক্তভোগীদের উপর নিষ্ঠুর আচরণের চিত্র সম্প্রতি ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর বিব্রতকর অবস্থার মুখে পড়ে বেইজিং। চীনের চাপের কারণে ওয়াসহ কয়েকটি শান গোষ্ঠী স্ক্যামে জড়িত থাকায় সন্দেহভাজনদের চীনা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। গত অগাস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার হাজারের বেশি মানুষকে সীমান্তের ওপারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু লাউকাইং শহরে থাকা পরিবারগুলো এই ব্যবসা বন্ধ করতে চায় না। কারণ এগুলো থেকে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করে থাকে তারা। বিভিন্ন সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে,পরে গত ২০শে অক্টোবর লাউকাইং শহরে আটকে পড়া হাজার হাজার মানুষকে উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়, যা আসলে ব্যর্থ হয়। স্ক্যাম সেন্টারের হয়ে কাজ করা প্রহরীরা পালানোর চেষ্টা করা অনেক মানুষকে হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হয়।এ ঘটনার পর পার্শ্ববর্তী চীনা প্রদেশের পৌর সরকার কঠোর ভাষায় এক প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠায়। যেখানে এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স সুযোগ বুঝে হামলা চালায়। চীনকে শান্ত রাখতে তারা এসব স্ক্যাম সেন্টার বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়।চীন প্রকাশ্যে একটি অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানিয়েছে কিন্তু অ্যালায়েন্সের মুখপাত্র বলেছে, যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়ে তারা চীন সরকারের সরাসরি কোন অনুরোধ পায়নি। কিন্তু তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হচ্ছে, সামরিক সরকারের পতন নিশ্চিত করতে যত বেশি সম্ভব ভূখণ্ড দখলে নেয়া। এনইউজি এর ওয়াদা মোতাবেক জান্তা সরকারকে উৎখাতের পর মিয়ানমারের নতুন ফেডারেল কাঠামোর আওতায় সমঝোতার দর কষাকষিতে এটিই তাদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সাহায্য করবে।টিএনএলএ দীর্ঘদিন ধরেই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা টা’য়াং স্ব-শাসিত অঞ্চলের প্রসার বাড়াতে চাইছিল। সংবিধান অনুযায়ী এই অঞ্চলটি তাদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। এমএনডিএএ লাউকাইং শহর এবং পার্শ্ববর্তী সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে চায়। ২০০৯ সালে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান অং মিং লাইংয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সামরিক অভিযানে ওই এলাকার দখল হারিয়েছিল তারা। আর সবাই তাকিয়ে আছে আরাকান আর্মির দিকে। এতদিন পর্যন্ত তারা শান রাজ্যের সংঘাতের পক্ষে সমর্থন দিয়ে এসেছে। তারা যদি রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর উপর হামলা চালাতে চায়, যেখানে তাদের বাহিনীর সবচেয়ে সদস্য রয়েছে এবং যারার এরইমধ্যে বিভিন্ন শহর ও গ্রামের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাহলে জান্তারা সেখানে বেশ বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যেই পড়বে। টিএনএলএ এর মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছে, তার গোষ্ঠী এখন আর সামরিক সরকারের সাথে কোন সমঝোতায় যেতে চায় না কারণ ওই সরকার বৈধ নয়। তাদের করা যেকোন চুক্তি ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে বাতিল করে দেবে। টা’য়াং, কোকাং এবং ওয়া গোষ্ঠীগুলো নতুন ফেডারেল ব্যবস্থায় তাদের নিজেদের জনগণের জন্য রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে এই গোষ্ঠীগুলো হয়তো মিয়ানমারে সামরিক শাসনের অবসানে সহায়তা করবে। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা শান রাজ্যের অন্য গোষ্ঠীদের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট। কাজেই যারা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করছেন তাদের জন্য এটি অন্য অনেক ইস্যুর মধ্যে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস্/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |