|
কবে বন্ধ হবে নারী ও শিশু পাচার
আর্নিয়া খানম আন্নি
|
![]() কবে বন্ধ হবে নারী ও শিশু পাচার দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্নভাবে পাচার হচ্ছে অসহায় নারী ও শিশু।শিশু পাচারকে আন্তর্জাতিকভাবে একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, যা বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে বিদ্যমান এবং প্রায় সবগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।বর্তমানে বাংলাদেশে নারী-শিশু পাচার হওয়ার মূল কারণ- দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নারীর নিম্নমানের পেশা, চাকরির সুযোগের অভাব, মাথাপিছু নিম্ন আয়, সম্পদে নারীর অনধিকার,অনৈতিক উপায়ে অধিক অর্থ উপার্জন, চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অভাব ইত্যাদি।সীমিত গবেষণায় এখনো শিশু পাচারের সমস্ত কারণ চিহ্নিত করা যায়নি, তবে দেখা যায় যে, দারিদ্র্যতা, মানবিক সংকট ও শিক্ষার অভাব শিশু পাচারের ক্ষেত্রে উচ্চ হারে অবদান রাখে। বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার হওয়ার মোট আটটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও পাচার হওয়া মানুষের ৫১ শতাংশই জীবিকার কারণে পাচারের শিকার হচ্ছেন।কাজের তাগিতে দেখা যাচ্ছে অনেকেই গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে,তাদের মাঝে অনেকেই শহর চেনে না, সঠিক কাজ সম্পর্কে অবগত নয় এমতাবস্থায় দেখা যায় এসকল মানুষগণ নানাভাবেই পাচারের মতো ভয়ংকর ফাঁদে পা দিচ্ছে।গ্রামে সঠিক কর্মসংস্থান না থাকায় পেটের তাগিদে অনেক মেয়েরাই কারো না কারো মাধ্যমে শহরে আসছে কাজ খুজতে আর তারাই বিভিন্নভাবে পাচার হচ্ছে আর তাদের জায়গা হচ্ছে বিভিন্ন পতিতালয়ে।এই ভয়ংকর ব্যবসায় বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও।কেননা ভিক্ষাবৃত্তির অন্যতম মাধ্যম শিশুরাই। এছাড়া অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও শিশুরা নানাভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ছে। আর এই ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভেঙে যাওয়া পরিবারের শিশু (২০ শতাংশ), প্রতারক সঙ্গী (১৩ শতাংশ), মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী (১০ শতাংশ), অভিবাসন জটিলতা (১০ শতাংশ), যেসব শিশু মা-বাবার পর্যাপ্ত যত্ন পায় না (৯ শতাংশ), স্বল্পশিক্ষা বা বিদেশি ভাষা না জানা (৬ শতাংশ) এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী (৩ শতাংশ)। অনেক গরীব পরিবার আছে যারা সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না তাদের বেশিরভাগই বিদেশ পাড়ি জমাতে চায় কিছু অর্থ উপার্জনের জন্য কিন্তু এসকল দরিদ্র মানুষগুলোই নানাভাবে পাচার হচ্ছে দেশের বাইরে।২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানব পাচার হয়েছে বাহরাইনে (২৭ শতাংশ)। এর পর সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে থাইল্যান্ড (১৭ শতাংশ), মালয়েশিয়া (১৫ শতাংশ) এবং ভারতে (১০ শতাংশ)। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য গন্তব্যেও পাচারের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশিরা।নারী ও শিশু পাচারে এখন শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। ইন্টারনেট ভিত্তিক এক পর্যবেক্ষণে পাওয়া যায় যে, ভারতের মুম্বাই,হায়দারাবাদ ও কলকাতা ভিত্তিক মানব পাচারের চক্রগুলো বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে প্রবলভাবে সক্রিয় রয়েছে।দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শিশু ও নারী পাচারের অন্যতম উৎপত্তিস্থল হিসেবে বিবেচিত। নারী ও শিশু পাচার বিষয়ক এ বছর জাতীয় গণমাধ্যম ও ২৮ টি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদ নিয়ে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের উপর তথ্য প্রকাশ করে।এতে বলা হয়, "৬৯৫ নারী ও কন্যা শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।এর মধ্যে নারী ৫০২ জন,১৯৩ জন কন্যা শিশু।ধর্ষণের স্বীকার ১০২২ জনের মধ্যে নারী ৩৬২ জন এবং কন্যা শিশু ৬৬০ জন।ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার স্বীকার ১৩ জন এবং কন্যা শিশু ৩৪ জন।আত্মহত্যা করেছে ৮৯০ জন, তাদের মধ্যে ৩৪৭ জন নারী,২৪৩ জন কন্যা শিশু। গৃহে সহিংসতার স্বীকার ১৭৯ নারী,২০ জন কন্যা শিশু। পাচার ও অপহরণের স্বীকার ৩২ জন নারী,১৩৬ জন কন্যা শিশু। এসকল বিষয়ে ঢাকা মহানগরীতে ৩০০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও শাস্তি হয়েছে মাত্র ২৪ জনের।"এসকল শাস্তির ক্ষেত্রে যেটুকু মামলা আছে তার সঠিক বিচার হয় না।যদি সঠিকভাবে বা কঠোরভাবে বিচারগুলো করা হতো এবং এসকল শাস্তিসমূহ যদি মানুষের নিকট প্রকাশ করা হতো তাহলে এসকল কাজে তারা এতো সহজেই পার পেয়ে যেতো না। বর্তমান সরকার নারী ও শিশু পাচার রোধে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন।নারী ও শিশু উন্নয়ন, নারী নির্যাতন বন্ধ,নারী পাচার প্রতিরোধ, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা বিধান এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল স্রোতধারায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাসহ নারীর সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি এই মন্ত্রণালয়ে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ১৮টি প্রকল্প ও ২১টি কর্মসূচি চলমান রয়েছে।সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের সমন্বিত সেবা প্রদানের জন্য নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম এর আওতায় ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল, ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরী, ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সিলিং সেন্টার , রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সিলিং সেন্টার, ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার বা ন্যাশনাল টোল ফ্রি হেল্পলাইন ১০৯, মোবাইল অ্যাপস জয় তৈরী করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার, অসহায় নারীদের আইনী সহায়তা প্রদানের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে নারী নির্যাতনের প্রতিরোধ সেল এবং নারীদের সাময়িক আবাসনের জন্য শেল্টার হোম তৈরী করা হয়েছে। নারীদের সুরক্ষায় বিভিন্ন আইন ও বিধি যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০২০);পারিবারিক সহিংসতা(প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা, ২০১৩; বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন, ২০১৭; বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৮; ডিএনএ আইন, ২০১৪; যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮; শিশু দিবাযত্ন আইন, ২০২১ ইত্যাদি প্রণয়ন করা হয়েছে।নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ৬(১) ধারা অনুযায়ী শিশু পাচারকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আর্থিক দণ্ডও হতে পারে। আবার এই আইনেরও ৬(২) ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি নবজাতক শিশুকে হাসপাতাল, শিশু বা মাতৃসদন, নার্সিং হোম, ক্লিনিক ইত্যাদি বা সংশ্লিষ্ট শিশুর অভিভাবকের হেফাজত থেকে চুরি করেন, তবে তিনিও শিশু পাচারের অপরাধে অপরাধী হবেন এবং একইরূপ শাস্তি পাবেন।তবে আইন প্রনয়ণ করলেই হবে না এর সঠিক প্রয়োগ করা প্রয়োজন।এসকল আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না বলেই অপরাধী তার অপরাধ নির্দিধায় করে বেড়ায়। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ প্রশাসনের সকলকেই এই বিষয়ে অবগত হওয়া প্রয়োজন এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে জনগনকে সচেতন করা প্রয়োজন । পাচারকৃত শিশুরা শিক্ষার অভাবে জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীল কর্মীদের বড় ক্ষতি হয়।জাতিসংঘের জিআইএফটি শিশু পাচারকে জাতীয় ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকির উল্লেখযোগ্য সূচক হিসেবে উল্লেখ করেছে।নারী ও শিশু পাচার রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য গণমাধ্যম নিতে পারে বড় ধরনের ভুমিকা। সুসংঘবদ্ধ পাচারকারীরা বছরের পর বছর এ অপরাধ সংঘটিত করে চললেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় মনোভাবের কারণে। নারী-শিশু পাচার বন্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কঠোর হতে হবে।বিভিন্নরকম ক্যাম্পেইন করে, সংবাদ প্রচার করে হলেও সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে নারী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে।নারী ও শিশু পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থায় জনগণের কাম্য। লেখক : শিক্ষার্থী, আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ। |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |