আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ও কিছু কথা
সাইফুল্লাহ মানছুর
|
‘বহু ভাষায় সাক্ষরতা, উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা' স্লোগানের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে (৮ সেপ্টেম্বর) পালিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। সাক্ষরতার সঙ্গে একটি দেশের উন্নয়ন গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সাক্ষরতার সঙ্গে শিক্ষা এবং শিক্ষার সঙ্গে উন্নত জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সাক্ষরতা আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত মানবীয় অধিকার হিসেবে বিশ্বে গৃহীত হয়ে আসছে। এটি ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন,সামাজিক ও মানবীয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণযোগ্য।শিক্ষার সুযোগের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে সাক্ষরতার ওপর। সাক্ষরতা মৌলিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবেও কাজ করে। দারিদ্র্য হ্রাস, শিশু মৃত্যু রোধ, সুষম উন্নয়ন এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি বিকশিত করণের ক্ষেত্রেও সাক্ষরতা প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হয়।সবার জন্য শিক্ষা এ স্লোগান বাস্তবায়ন করতে সাক্ষরতাকে ভিত্তি হিসেবে মনে করার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একটি মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা মানুষকে সাক্ষরতা ও দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করতে সহায়তা করে। সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে প্রেরণে উৎসাহিত হন, অব্যাহত শিক্ষায় নিজেকে প্রবেশ করতে উৎসাহ পান এবং উন্নয়নের দিকে দেশকে ধাবিত করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট ও সরকারকে সাহায্য করে থাকেন। ![]() লেখক: সাইফুল্লাহ মানছুর ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে পৃথিবীর সব দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো দিবসটি প্রথম উৎযাপন করে।তবে বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ১৯৭২ সাল থেকে। দিবসটি পালনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষকে বুঝাতে চায়, সাক্ষরতা একটি মানবীয় অধিকার এবং সর্বস্তরের শিক্ষার ভিত্তি। প্রতি বছর একটি বিশেষ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সাক্ষরতা দিবস পালন করা হয়। ১৯৬৭ সালে ইউনেস্কো প্রথম সাক্ষরতার সংজ্ঞা চিহ্নিত করে এবং পরবর্তী সময়ে প্রতি দশকেই এই সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম দিকে শুধু নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো, কিন্তু বর্তমানে সাক্ষর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য অন্তত তিনটি শর্ত মানতে হয়। ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে এবং দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাব নিকাশ করতে পারবে।বর্তমানে এই সংজ্ঞার উপর নির্ভর করে সাক্ষরতা নিরূপণ করা হয়। সাক্ষরতা অর্জনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে সত্য কিন্তু এখনও বহু চ্যালেঞ্জ থেকে গেছে। সাক্ষরতার ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হয়েছে সেটি অসম, দেশে দেশে মানুষে মানুষে এর ভিন্নতা স্পষ্ট। এক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয় তা সাক্ষরতা দিবসে আলোচনার দাবি রাখে। ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পৃথিবীতে ৭৭৫ মিলিয়ন মানুষ সাক্ষরতার মৌলিক ধারণা থেকে দূরে রয়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নয়। এই ২০ শতাংশের মধ্যে আবার প্রায় ৬৬ শতাংশ হচ্ছে নারী। প্রায় ৭৫ মিলিয়ন শিশু এখনও বিদ্যালয়ে যায়নি কিংবা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে। বিশ্বে পনেরো বা তার বেশি বয়সিদের সাক্ষরতার হার ৮৬.৩ শতাংশ, তার মধ্যে পুরুষ ৯০ শতাংশ এবং নারী ৮২.৭ শতাংশ। ২০০৬ সালে ইউনেস্কোর গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিম আফ্রিকায় সাক্ষরতার হার সবচেয়ে কম। বিশ্বে যেসব দেশ সবচেয়ে কম সাক্ষরতাসম্পন্ন তার মধ্যে রয়েছে বার্কিনা ফাসো (১২.৮ শতাংশ), নাউজার ১৪.৪ শতাংশ, এবং মালি ১৯ শতাংশ। ২০১৫ সালে এই হার কিছুটা বেড়েছে সাব সহারান আফ্রিকায় ৬৪ শতাংশ। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ সাক্ষরতা দশক ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে এর সঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা যুক্ত করে ‘সাক্ষরতা এবং স্বাস্থ্য’ হিসেবে তা পালিত হয়েছিল। ২০১১-১২ সালে এ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সাক্ষরতা ও শান্তি’। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। যেহেতু সাক্ষরতার সঙ্গে উন্নয়নের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।সেহেতু সাক্ষরতার প্রতি অত্যাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এদেশে সাক্ষরতার হার বর্তমানে ৭৩.৯ শতাংশ এবং আমাদের মাথাপিছু আয় ১৯০৯ ডলার। ১৯১৮ সালে আমাদের দেশে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরপর ১৯৩৪ সালে খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ ও নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র। ১৯৬০ সালের ভি-এইড কার্যক্রমের আওতায় সফলভাবে পরিচালিত হয় বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্যুরো অব নন ফরমাল এডুকেশন’। ১৯৯১ সালে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই সরবরাহ করা হয়েছে এবং মেয়েদের জন্য শিক্ষা বৃত্তি ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে ছয় থেকে দশ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য বিনামূল্যে মৌলিক শিক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো সাক্ষরতা বৃদ্ধির ইতিবাচক পদক্ষেপ। সাক্ষরতাকে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং মানব উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ধরা হয়। কারণ দারিদ্র্য হ্রাস, শিশুমৃত্যু রোধ, সুষম উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য সাক্ষরতা হার বৃদ্ধি জরুরি। সাক্ষরতার পরিবর্তিত সংজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের অবস্থান কোথায় স্ট্যান্ডার্ড মানদণ্ডে সেটি পরিমাপ করতে হবে, শুধুমাত্র সংখ্যার বৃদ্ধিতে উন্নীত করে তৃপ্তি পাবার অবকাশ নেই। [মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন] সাইফুল্লাহ মানছুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |