ট্যাগের রাজনীতি, ত্যাগের রাজনীতি
মো. আখতার হোসেন আজাদ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২০, ১২:২৬ পিএম

সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মীকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক শিবির আখ্যা দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজের খবর প্রকাশ হওয়ার পর বেশ আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। স্কুলজীবন থেকে বর্তমান পর্যন্ত ছাত্রলীগে যুক্ত থাকা ও আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য হবার পরেও শিক্ষকের থেকে শিবির তকমা পেয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ফেসবুকে কষ্টভরা আর্তনাদের স্ট্যাটাসও প্রদান করেন। নিজের মতবিরোধ স্টাটাস হওয়ায় উক্ত শিক্ষার্থীকে বাটপার বলে সম্বোধন করা শিক্ষক অবশ্য এমন কর্মের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন। এটি কেবল একটি উদাহরণমাত্র। বাংলাদেশে বিশ্বজিৎ, আবরারের মতো এমন অনেক ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। ব্যক্তিগত মতবিরোধ বা আক্রোশের জেরে সাধারণ নাগরিকদের বিরোধী মতাদর্শের কর্মী বলে হেনস্তা বা শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে নির্যাতনের খবর প্রায়ই শোনা যায়।

ইংরেজি ট্যাগ (Tag) শব্দটির অর্থ জুড়ে দেওয়া। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে সুবিধা আদায় করে নেবার এটি বহুল ব্যবহৃত একটি মহৌষধ। এটি সেবনের ফলে একদিকে যেমন যেকাউকে হেনস্থা বা দমন করা যায়, একইভাবে ক্ষমতাসীন দলের তকমা মেখে নিজের যেকোন হীন উদ্দেশ্য সাধন করাও যায়।  ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন কর্তৃক ভিন্ন মতাদর্শী ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীকে পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেবার ঘটনার খবর প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। এই অধিকার বা ক্ষমতা একটি রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের আছে কি না তা অনেক আলোচনার ও তর্ক-বিতর্কের বিষয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতার গদিতে বিচরণ করেছে বা করে, তখন উক্ত রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন কেমন যেন লাগামহীন হয়ে পড়ে!

ব্যক্তিগত আক্রোশ থাকলে কিংবা কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় থাকা কোন দলের তকমা দিয়ে হেনস্থা করার রাজনীতি বর্তমানে বহুলভাবে ব্যবহৃত হলেও এর প্রচলন অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। মূলত জামায়াত-বিএনপি জোটের শাসনামলে এর চর্চা শুরু হয়। কেউ মতের বিরোধিতা করলেই ইসলামের দুশমন বা নাস্তিক অ্যাখ্যা দিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালানোর তখনকার ঘটনাসমূহ আজও রক্ত হিম করে দেয়। নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার সংখ্যাও নেহায়েত কম ছিল না। আবার শিবিরের রগ কাটার ঘৃণ্য ইতিহাসও কারো অজানা নয়। মূলত বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা পরায়ণ নীতি চর্চার ফলে দেশের রাজনীতি ভীষণভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। ভালোর সাথে ভালোর প্রতিযোগিতা না হয়ে তুলনামূলক প্রতিশোধের রাজনীতি চর্চার ফলে দেশের মানুষ এমন দূষিত রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

অপরদিকে ক্ষমতাসীন দলের ট্যাগ বা তকমা লাগিয়ে বিভিন্ন অপকর্মকারীর সংখ্যাও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাইসেন্স বিহীন যানবাহন বিশেষ করে মোটর সাইকেলের পেছনে লাইসেন্স প্লেটে রাজনৈতিক নাম লিখে নির্বিঘ্নে চলাফেরা, ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি যেন নিত্য ঘটনা। বিশেষ করে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে চাঁদাবাজির পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণ। হেনস্তার ভয়ে ভুক্তভোগী থাকেনও নির্বিকার।

আবার নেতার সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করে নেতা সাজার মিকে সংস্কৃতি বর্তমান রাজনীতিতে বহুলভাবে প্রচলন শুরু হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। সুবিধা আদায় ও স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে সরকারি দলের তকমা গায়ে মাখানোর রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে দলীয় সভা, চা-চক্র, মিছিল কিংবা রাজনৈতিক সমাবেশে প্রচুর লোকসমাগম হলেও প্রকৃত আদর্শিক কর্মীর সংকটে ভুগছে প্রতিটি রাজনৈতিক দল। এমন আদর্শহীন সুবিধাবাদী লোকেরা নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়; ফলে ভাবমূর্তি নষ্ট হয় সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের।
মো. আখতার হোসেন আজাদ

মো. আখতার হোসেন আজাদ

দেশের ক্যাম্পাস সমূহে হলে সিট পাওয়া ও রাজনৈতিক পদ-পদবীর লোভে ‘সহমত ভাই’ সংস্কৃতির চর্চা চলে ধুমসে। আবার কখনো রাজনীতিতে না আসা সিজিপিএ ভালো থাকা শিক্ষার্থীরও দেখা মেলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের মিছিলের সামনের সারিতে। আসলে ট্যাগের রাজনীতির ধরন ও উদাহরণের শেষ নেই। প্রত্যেকেই নিজস্ব কায়দায় প্রদর্শন করে নিজস্ব কারিশমা।

বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকটা পরিবারতান্ত্রিক রূপ নিয়েছে। দাদা, বাবা, সন্তান, তারপর নাতির দখলেই চলে বাংলাদেশের স্থানীয় রাজনীতি। এতে নতুন নেতৃত্ব যেমন সৃষ্টি হচ্ছে না, তেমনি অনেক যোগ্য ব্যক্তি রাজনীতিতে যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছে না। আবার যেখানে পরিবারতান্ত্রিকতার প্রভাব একটু কম, সেখানে চলে ভাইতান্ত্রিক রাজনীতি। গ্রুপিং বা নেতার রাজনীতি চর্চার ফলে একদিকে যেমন নীতির রাজনীতি চাপা পড়ে, তেমনি অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে সৃষ্টি হয় নানা সংকটময় অবস্থার।

পূর্বে দেখা যেত যারা দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে কিংবা বিভিন্ন আন্দোলনে নিঃস্বার্থভাবে ত্যাগ স্বীকার করেন, বিরোধী শক্তির দ্বারা নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতেন তাদের দলীয়ভাবে বিশেষ মূল্যায়ন করা হতো। কিন্তু বর্তমানে কেমন যেন এই সংস্কৃতি ফিকে হয়ে গেছে। নির্যাতনের শিকার ত্যাগী নেতা-কর্মীরা বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন, পরিস্থিতি বুঝে সুযোগ করে নিচ্ছে স্বার্থান্বেষীরা। বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র স্বপ্নদ্রষ্টা কারিগর হিসেবে নিজেদের দাবি করলেও নেতৃত্ব নির্বাচনে নিজ দলের ভেতরে কতটুকু গণতন্ত্র চর্চা হয় সেটি নিয়েও মাঝে মাঝে প্রশ্ন উঠে। উর্দ্ধতন নেতার সাথে ব্যক্তির সাথে বিশেষ সম্পর্কের ফলে কিংবা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে রাতারাতি নেতা বনে যাবার খবরও পত্রিকার পাতায় প্রকাশ হয়। অর্থ এবং যথাযথ লবিং না থাকার দরুণ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা থাকেন উপেক্ষিত।

রাজনীতির উদ্দেশ্য দলীয় আদর্শ বাস্তবায়ন করে জনগণের সেবা করা। কিন্তু বাংলাদেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের মূল উদ্দেশ্য যেন ক্ষমতার গদিতে আসীন হওয়া। অপরদিকে রাজনৈতিক দলের প্রত্যেক সদস্যের মাঝে থাকে দলীয় পদলিপ্সার লালাগন্ধ । এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, কোন রাজনৈতিক দলের প্রধান উদ্দেশ্য যদি হয় ক্ষমতার গদিতে আসীন হওয়া আর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য যদি হয় পদ-পদবী, তবে এমন আকাক্সক্ষা সে দেশ বা অঞ্চলের রাজনীতিতে অরাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের রাজনীতি সে পথেই হাঁটছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে বিগত ৬ বছরে দেশের মোট তিন হাজার ৭১০টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। তাতে মারা গেছেন ৬৩৫ জন, আহত হয়েছেন প্রায় ৪২ হাজার। তাই অবিলম্বে যদি দেশের রাজনীতির চিকিৎসা করা না হয়, তবে চিরপঙ্গুত্ব বরণ করে দেশের উন্নয়নের প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে এই প্রতিহিংসার দূষিত রাজনীতি। ত্যাগীদের যেমন মূল্যায়ন করতে হবে, তেমনই ট্যাগীদেরও রুখতে হবে। ‘সে ভালো, তুমি ভালো, আমি আরো ভালো হতে চাই’ হোক বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান আদর্শ, এই সকলের প্রত্যাশা।


লেখক: শিক্ষার্থী, 
লোক প্রশাসন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম।




ডেল্টা টাইমস্/মো. আখতার হোসেন আজাদ/সিআর/জেড এইচ

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com