প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে সচেতন হই, দেশের উন্নয়নের পথকে সুগম করি
তানভীন সুইটি
|
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির কারণে সারাদিন রোদের দেখা মেলেনি আজ। দুই বছর বয়সী ছোট্ট আয়ানের ভেজা কাপড়গুলো তাই ওর আম্মু গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে শুকিয়ে নিয়েছে। শীতকালেও যখন মাঝে মাঝে রোদ উঠে না, আয়ানের আম্মু এভাবেই কাপড় শুকানোর কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। অন্যদিকে শহরের অন্য বাসিন্দা শারীকাদের বাসায় প্রায়শ এমন হয় যে একটি দেশলাইয়ের কাঠি বাঁচানোর জন্য সকালের রান্না শেষে আর গ্যাসের চুলা বন্ধ করা হয় না , যেহেতু ঘণ্টাখানেক পরে আবার দুপুরের রান্নার কাজ শুরু করতে হবে: তবুও একটা দেশলাইয়ের কাঠি জমা হলো বলে কথা! উপরের ঘটনা দুটোই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ থেকে নেওয়া। এভাবে করে আমরা নিজেরা নিজেদের দেশের অত্যন্ত মূল্যবান এক সম্পদের অপচয় করে চলেছি চোখের সামনে। প্রতিনিয়ত যে আমরা এভাবে গ্যাসের অপচয় করে চলেছি , অপচয় রোধের ব্যাপারে আমরা কতটুকু সচেতন? আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই প্রাকৃতিক এ সম্পদ রক্ষার্থে??
অপচয়ে সমুদ্র শুকায় বলে একটা কথা লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে। গ্যাস একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। তবে এ সম্পদের যোগান সীমাবদ্ধ, নানাবিধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে চাহিদা অপরিসীম। প্রাকৃতিক গ্যাস অনবায়নযোগ্য শক্তির উৎসও বটে। অনবায়নযোগ্য শক্তি হলো এমন একধরনের শক্তি যা একবার ব্যবহার করা হয়ে গেলে আর পুনরায় বা বারবার ব্যবহারের কোনো সুযোগ থাকে না, ব্যবহারের সাথেই নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই আমাদেরকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ সম্পদের ব্যবহারে সদা সতর্ক ও বিচক্ষণ হতে হবে। ![]() তানভীন সুইটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জ্বালানি সম্পদ হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। সিলেটের হরিপুরে ১৯৫৫ সালে বার্মা অয়েল কোম্পানি সর্বপ্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেন। গ্যাসের উত্তোলন শুরু হয় ১৯৫৭ সাল থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৮ সালে দেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। দেশের জ্বালানি চাহিদার শতকরা ৭৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে মেটানো হয়। অতএব নিঃসন্দেহে বলা যায় যে দেশের উন্নয়নকে তরান্বিত করতে গ্যাসের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আধুনিক সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ গ্যাসের রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার ক্ষেত্র। জ্বালানি চাহিদার মূল উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে,বিভিন্ন শিল্প-কারখানায়,সার উৎপাদন থেকে শুরু করে গৃহস্থালি তথা রান্নাবান্নার কাজে পর্যন্ত। উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাস সহজলভ্য হওয়ায় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর চাহিদার এক বিশাল অংশের যোগান দিয়ে আসছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে রেখে চলছে তাৎপর্য ভূমিকা। গ্যাসের যথাযথ ব্যবহার, বণ্টন ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করার সমূহসম্ভাবনা রয়েছে। এতসব ব্যবহার সত্ত্বেও গ্যাসের অপচয় হয়েই যাচ্ছে। যার ফলে মজুদকৃত গ্যাসের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, একইসাথে গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে দ্রুত গতিতে। অপ্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে গ্যাস। নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ। আবাসিক বাসায় গ্যাস সংযোগ মিটার নেই। সামান্য একটা দেশলাইয়ের কাঠির জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছে চুলা। কি পরিমাণে গ্যাস পুড়ছে তার নেই কোনো হিসেব। গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি বের করার কোনো জোর প্রচেষ্টা নেই। ইাচ্ছা থাকিলে উপায় হয়। সদিচ্ছা থাকাটা যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য জরুরি। সদিচ্ছা থাকলে সমাধান খোঁজার পথে অগ্রসর হওয়া যায়। আমাদের প্রত্যেক নাগরিককে যার যার অবস্থান থেকে গ্যাস সংকট নিরসনে তৎপর হতে হবে। সমস্যার সমাধানে সরকারের সাথে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে। জ্বালানি চাহিদা পূরণে শুধু প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীল না হয়ে বিকল্প জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণে এগিয়ে আসতে হবে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে। গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এনএলজি আমদানি করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের উৎসাহিত করতে হবে বিকল্প জ্বালানির উৎস উদ্ভাবনের জন্য। সৌরশক্তি,বায়ুপ্রবাহকে ব্যবহার করা যেতে পারে জ্বালানির বিকল্প উৎস হিসেবে। বিকল্প জ্বালাানির উন্নত মাধ্যম হিসেবে সুপরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত কয়লা, পেট্রোল,ডিজেল,কেরোসিন প্রভৃতির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করা দরকার। কেননা, জ্বালানির এ উৎসগুলো পরিবেশের জন্য কম-বেশি ক্ষতিকর বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। বঙ্গোপসাগরের অধীকৃত জলসীমায় রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি তেল ও গ্যাস ‘গ্যাস হাইড্রেট বা জমাট বরফের স্ফটিক’ এর বিশাল ভান্ডার। প্রাকৃতিক গ্যাসের সুপার পাওয়ার গ্যাস হাইড্রেটের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আগামী দিনের জ্বালানি, অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ইতোমধ্যে জাপান গ্যাস হাইড্রেট উত্তোলন করতে সমর্থ হয়েছে। কানাডা,আমেরিকা, চীন, কোরিয়ার মত উন্নত রাষ্ট্রগুলো গ্যাস হাইড্রেট নিয়ে বহুমুখী গবেষণা চালাচ্ছে। আমাদের দেশেও যদি বঙ্গোপসাগরের তলদেশে অবস্থিত গ্যাস হাইড্রেটের উত্তোলনে অগ্রসর হতে পারে তাহলে জ্বালানির উৎস হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর চাপ ও নির্ভরশীলতা উভয়ই লাগব হবে। আমাদের দেশের মানুষের মাঝে অন্যের উপর দায় চাপানোর একটা অদ্ভুত প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অন্যের উপর দায় চাপানোর এ সংস্কৃতির ইতি টানতে হবে। সকাল-সন্ধ্যা অন্যের দোষ ধরা, অন্যের খুঁত খুঁজে বের করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আত্মসমালোচনার দিকে গুরত্বারোপ করতে হবে। সমস্যার সমাধানে নিজে উদ্যোগী হওয়া জরুরি। প্রত্যকের স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাসের অপচয় রোধে এগিয়ে আসতে হবে। সমস্যা সমাধানে নাগরিক উদ্যোগ কার্যকরি ও গুরুত্ববহ। প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ করার দ্বারা দেশের উন্নয়ন হলে আমাদের উন্নয়ন হবে-এ মানসিকতা ধারণ করা শিখতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অধিকার জনগণের রয়েছে। তবে ‘এখনি ব্যবহার করে একেবারে শেষ করে ফেলতে হবে’ এমন দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে। এ সম্পদ রক্ষার্থে সরকারের দায়িত্ব অস্বীকার করার জো নেই বরং সরকারের হস্তক্ষেপ জরুরি বটে। সর্বোপরি,দেশের জনগণ, যথাযথ কর্তৃপক্ষসহ সরকারের তত্বাবধানেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তানভীন সুইটি শিক্ষার্থী,অর্থনীতি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডেল্টা টাইমস্/তানভীন সুইটি/সিআর/জেড এইচ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |