উন্নয়নের আয়নায় প্রিয় বাংলাদেশ
মো. আখতার হোসেন আজাদ
প্রকাশ: বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ৩:০১ পিএম

লাখো শহীদের রক্ত আর মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৯তম বিজয় দিবস আজ। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মাথাপিছু আয়, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, বাণিজ্যসহ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র আখ্যা দেওয়া দেশটি আজ বিশ্ব দরবারে বীরদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় বাংলাদেশ বিদেশী সাহায্যের মুখাপেক্ষী ছিল। কালের প্ররিক্রমায় বাংলাদেশ সাবলম্বী হয়েছে। তবে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে যারা আকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছে, জাতি তাদের সবসময় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে।

নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে বাংলাদেশ এখন সমৃদ্ধির পথে এগুচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। জীবনযাত্রার মান, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সার্বিক প্রবৃদ্ধি সর্বত্রই বাংলাদেশ এগিয়েছে অকল্পনীয়রূপে। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উন্নয়ন এবং কাক্সিক্ষত উন্নয়ন নামে দুটি শব্দ প্রচলন হয়েছে। বাংলাদেশে উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু কাক্সিক্ষত উন্নয়ন প্রতিফলন হয়েছে কিনা তা নিয়ে বেশ আলোচনা চলে চায়ের টেবিল থেকে টেলিভিশন-টকশোতে। আমাদের দেশের উন্নয়ন নিয়ে একটি রসাত্মক গল্প প্রচলিত রয়েছে। একটি গ্রামে ছোট ব্রিজ নির্মাণে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী নিজের জন্য বকশিস হিসেবে ৭ লাখ রেখে বাকি টাকা প্রেরণ করেন স্থানীয় দপ্তরে। স্থানীয় সাংসদের বকশিস স্বরূপ চলে যায় আরো ৩ লাখ টাকা। ১০ লাখ টাকা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে দিলে সেখান থেকে স্থানীয় নেতা, বিভিন্ন ছাত্রনেতাদের কিছু বকশিস দিতে হয়। সব কিছু বাদ দিয়ে নির্মাণকারী ৫ লাখ টাকার কাজ করেন। এভাবেই আমাদের দেশে বকশিসের উন্নয়ন হয়ে আসছে। এমন উন্নয়ন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে নিজেদের যুক্তি পেশ করে থাকেন। কেউ বলেন যেখানে কিছুই ছিল না, সেখানে কাজ হচ্ছে এটিই ভালো। এটিই উন্নয়ন। আরেক শ্রেনী বলেন, কাজ হলেও তো কাক্সিক্ষত মানের কাজ হয়নি। ভঙ্গুর অবকাঠামো নির্মাণের নামে হয়েছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার উন্নয়ন।
মো. আখতার হোসেন আজাদ

মো. আখতার হোসেন আজাদ

দেশে বড় বড় প্রকল্প হলেই যেন বড় বড় দুর্নীতির দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনায় অনিয়মের মহামারী, সম্প্রতি নানা আলোচনায় রূপ পাওয়া পদ্মা সেতু নিয়েও জল ঘোলা কম হয়নি। দেশের অবস্থান এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যত বড় উন্নয়ন, তত মাত্রাই যেন দুর্নীতি! স্থানীয় অবকাঠামো নির্মাণে রডের বদলে বাঁশের ব্যবহারের খবরও পত্রিকায় কম প্রকাশ হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন দুই প্রকার। দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান। দৃশ্যমান উন্নয়ন যেটি সাধারণত সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। যেমন: বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, চিকিৎসা, সেবা, কৃষিখাতসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ায়। আবার পরিসংখ্যানগত উন্নয়ন অর্থ্যাৎ মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রভৃতিও একটি দেশের উন্নয়নের সূচক।

অদৃশ্যমান উন্নয়ন চোখে দেখা যায় না। কিন্তু অনুভব করা যায় এবং এর সুফলও ভোগ করা যায়। অদৃশ্যমান উন্নয়নের উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সামাজিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সরকারি আমলা-কর্মচারী থেকে সর্বস্তরের নাগরিকদের নৈতিকতার মানদন্ড প্রভৃতি। ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রমাণিত যে, দৃশ্যমান উন্নয়ন ও অদৃশ্যমান উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একে অপরের পরিপূরক। দুটির পূর্ণমাত্রা না পেলে একটি দেশ কখনো কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না।

আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, শিক্ষিতের হার বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষার সাথে নৈতিকতার সংমিশ্রণ না ঘটার ফলে সমাজে জনসংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু মানুষ বাড়েনি। প্রতিনিয়ত সমাজে ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা অপকর্ম বেড়েই চলেছে। নৈতিকতার অবক্ষয় এতোটা নিম্ন স্তরে পৌঁছেছে যে ধর্ষণ যেন একটি সাধারণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। শিক্ষকের কাছে ছাত্রী নিরাপদ নয়, বন্ধুদের কাছে নারী বন্ধুটি নিরাপদ নয়। এসবে যোগ হয়েছে বলাৎকার। কোন অপরাধকর্ম প্রাথমিক অবস্থায় শক্ত হাতে দমন করতে না পারলে তা মহামারী আকার ধারণ করে।
তুলনামূলক রাজনীতি পড়াতে গিয়ে একজন শিক্ষক বলছিলেন, অন্যান্য দেশে ক্ষমতায় থাকা সরকার ৫ তলা ভবন তৈরি করার পর ক্ষমতা পরিবর্তন হলে পরবর্তী সরকার তার নির্মাণ কাজ অব্যাহত রেখে ভবনটি পরিপূর্ণ করে। বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে নতুন সরকারের প্রথম কাজ হয় নির্মাণাধীন ভবনটি ভেঙে নিজের পছন্দের নামে নাম দিয়ে পুনরায় নতুন করে ভবন তৈরি করা হয়।

বাংলাদেশের বাগযুদ্ধের রাজনীতি উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। দেশের সবকিছুতে পরিবর্তনের হাওয়া লাগলেও রাজনীতির অঙ্গনে তার ঢেউ লাগতে সক্ষম হয়নি। অবিরত অবিশ্বাস ও প্রতিহিংসার রাজনীতির ফলে মানুষ এমনভাবে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে যে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনেও তাদের কোন আগ্রহ আর নেই।

বাংলাদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দলসমূহ পরস্পরের দোষারোপের প্রতিযোগিতায় এতটা ব্যস্ত থাকেন যে সামাজিক শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধ ক্রমেই ধসে যাচ্ছে তাতে কারো ভ্রƒক্ষেপ নেই। ক্ষমতার গদিতে যখন যে সরকার এসেছে এবং বিরোধী দলে অবস্থান করেছে প্রত্যেকেই এমন উদাসীন কর্ম করেছে। সমাজে আজ যৌতুক একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেশে যৌতুকবিরোধী আইন থাকলেও প্রকাশ্যেই চলছে দেনদরবার। যৌতুকের ফলে নির্যাতনের মাত্রাও বেড়েছে। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। সমাজে তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যৎ ত্রাস গোষ্ঠীর। এছাড়াও গ্রাম পর্যায়ে দেশের দূষিত রাজনীতির বাতাস লাগার ফলে গ্রামীণ সমাজ আজ ঐক্যবদ্ধ থেকে খন্ডিত খন্ডিত হয়ে প

ড়েছে।
গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে গ্রামীণ সমাজের মানুষের উন্নয়ন ব্যতীত কখনো জাতীয় উন্নয়ন কল্পনাও করা যায় না। স্বাধীনতার পর থেকে গ্রামীণ সমাজের আহামরি খুব উন্নয়ন ঘটেছে তা বলা যাবে না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, তথ্য-প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিছুতেই খুব একটা আধুনিকায়ন বা উন্নয়ন হয়নি। যেটুকু হয়েছে তা নিতান্তই স্বাভাবিক। বরং অনেকাংশে কম। বাংলাদেশের উন্নয়ন সাধন হয়েছে অনেকটা শহরকেন্দ্রিক। শিল্প কারখানা, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, নানাবিধ কর্মক্ষেত্র নানাবিধ সুবিধার জন্য শহরে গড়ে উঠেছে। গ্রামের মানুষ হচ্ছে শহরমূখী।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব, রাষ্ট্র নিয়ে প্রকৃত চিন্তা, প্রকৃত দেশপ্রেম এবং ছোট্ট দেশে অতিরিক্ত রাজনীতির ফলে বাংলাদেশে যে পরিমাণ অগ্রগতি প্রত্যাশা ছিল, বাস্তবিক অর্থে তার প্রতিফলন ঘটেনি। কেবলমাত্র সুউচ্চ অট্টালিকা এবং অবকাঠামো দিয়ে প্রকৃত উন্নয়ন বিবেচনা করা সম্ভব নয়। জনগণের জীবনযাত্রা, জনজীবনে সুশিক্ষা ও মূল্যবোধ, রাজনৈতিক শ্রদ্ধা, সর্বস্তরে সুষম উন্নয়নের মাধ্যমে দেশে প্রকৃত উন্নয়ন সাধন সম্ভব হবে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা করে সুখী-সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই।

শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।








ডেল্টা টাইমস্/মো. আখতার হোসেন আজাদ/সিআর/জেড এইচ

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com