বিজয় পরবর্তী স্বাধীনতার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
মো. জাফর আলী
|
সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করে প্রায় ২০০ বছর এই অঞ্চলকে শোষণের শেকলে আবদ্ধ করে রেখেছিল। ভারতবর্ষের মানুষ অনেক প্রতীক্ষার পর ১৯৪৭ সালে, ইংরেজদের শাসন থেকে মুক্তির সৌভাগ্য অর্জন করে এবং পরে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমন্বয়ে) ও ভারত নামের দুটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠিত হয়। পুরো ভারতবর্ষ স্বাধীন হলেও, পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনস্থ হওয়ার কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নামক এই অঞ্চলটি যেন স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়। এভাবে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় নিষ্পেষণের পর অবশেষে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদাররা ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট (বাঙালি হত্যার নীলনকশা হিসেবে ১৭ মার্চে যেটির পরিকল্পনা করা হয়) নামক একটি অভিযান পরিচালনা করে ঢাকায় ভয়ানক এক গণহত্যা সংঘটিত করে। একপর্যায়ে, হানাদাররা পুরো বাংলাদেশে অভিযান শুরু করে এবং গণহত্যার পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করে। এভাবে দীর্ঘ নয় মাস ধরে এরকম তাণ্ডব তারা চালিয়েছিল। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষজন মাতৃভূমিকে বাঁচানোর তাগিদে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল এবং পুরো দেশব্যাপী তারা যার যার জায়গা থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এ যুদ্ধে অর্থনৈতিক ভিত যেন ধ্বংসই হয়ে গিয়েছিল। অভাব আর জীবন হারানোর শঙ্কায় চতুর্দিক থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল প্রতিনিয়ত। এমন অবস্থায় বিশ্বের অনেক পরাশক্তি দেশসমূহও পাকহানাদারদের গণহত্যাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছিল। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের মুখে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করতেও দেখা গিয়েছে। ![]() বিজয় পরবর্তী স্বাধীনতার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি অবশেষে, দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, ৩০ লক্ষ শহীদের তাজা রক্ত ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি রক্তপিপাসুদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় সোনার বাংলার কাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীনতা। শুধু মনোবল, একতা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে যার যা আছে তাই নিয়েই সংগ্রাম করে, অস্ত্রধারী বৃহৎ শক্তিকেও যে কাবু করে দেয়া যায় এবং বিজয় ছিনিয়ে আনা যায় সেটি নতুন করে প্রমাণিত হয় উক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে। "বঙ্গবন্ধুর জীবন, স্বপ্ন ও আজকের বাংলাদেশ" নামক আমার একটি প্রবন্ধে আমি উল্লেখ করেছিলাম যে, মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, এই তিন সূচকের মানদণ্ডে আজকের বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অবস্থান করছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর মাথাপিছু আয় ২০৭৯ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগোচ্ছে। ৫০ বছর পূর্বেও যে বাংলাদেশের অস্তিত্বই ছিলনা সেই বাংলাদেশ এখন একটি স্যাটেলাইটের মালিক। এছাড়া আরো কয়েকটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণসহ মঙ্গল অভিযানের স্বপ্নও দেখে এদেশ। একসময় যে বাংলাদেশকে কেউ চিনতই না সেই বাংলাদেশ, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, চামড়া শিল্প ও কৃষিসহ বিভিন্ন রপ্তানিপণ্য, জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাফল্য, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীদের বিশ্বব্যাপী পদচারণা , ক্রিকেট, অন্যান্য খেলাধুলা ও বিভিন্ন প্রতিযোগীতাসহ বিভিন্ন শিল্প-সংস্কৃতির জন্য পুরো পৃথিবীতে আজ বাংলাদেশের সুপরিচিতি রয়েছে। ছোট্ট ও জনবহুল একটি দেশ হয়েও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দক্ষ ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে ইতিবাচক সফলতায় এক দৃষ্টান্তের নাম যেন বাংলাদেশ। শিক্ষাখাত, স্বাস্থ্যখাত, নারী ও শিশুর উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটালাইজেশন, কৃষি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, প্রবাসী শ্রমিক উন্নয়ন, বিদ্যুৎ শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতের উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি, দক্ষ ভূমি ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একটি উদাহরণ। আর বাংলাদেশে এত উন্নয়নের পাশাপাশি কিছু জাতীয় অসামঞ্জস্যতারও ব্যাপক বৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে। তন্মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি, ধর্ষণ ও খুন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পত্র-পত্রিকা খুললেই প্রতিনিয়ত এসব খবর আমরা দেখতে পাই। যেটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক এবং যা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় মোটেও মেনে নেয়ার মতো ব্যাপার নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যদিও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি এবং অতি ধনীদের পরিমাণও অনেক বেশি, তাছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তী বাজেটের তুলনায় এখনকার বাৎসরিক বাজেটের পরিমানও লক্ষ গুণে বড়। তারপরও এদেশে দারিদ্রের হার কিন্তু কম নয়। স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো শহরগুলোতে অনেক মানুষকে রাস্তায় ঘুমোতে দেখা যায়, বস্তিতে থাকতে দেখা যায় অনেককেই, তাছাড়া অনেককে চিকিৎসা ও শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বরাবরই বঞ্চিত হতে হয়। কারণ, পুঁজিবাদের ছোঁয়ায় ধনীরা ধনীই হচ্ছে কিন্তু গরীবের ইতিবাচক পরিবর্তনের হার খুব সামান্যই। লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশে ব্যাপকহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়নের পাশাপাশি সকলের সমান সুযোগ-সুবিধা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সরকারকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে বেকারত্বের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সেই বেকারদের দ্বারা অর্থের জন্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। যা দেশের জন্য অশনি সংকেত হয়ে দাড়াচ্ছে। আবার আমাদের দেশের যুবসমাজের মধ্যে মাদকের ভয়াল থাবাও যেন জমের মত ঝেঁকে বসেছে। অধিকাংশ যুবকদের মাদক সেবনের ফলে শরীর, মন, চরিত্রসহ পুরো জীবনেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে অনেকেই অসংখ্য অপরাধ ঘটাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। তার মধ্যে অশ্লীলতা ছড়ানো, গোপন ফাইল বা তথ্য ফাঁস করে দেয়া, হুমকি দেয়া, গুঁজব ছড়ানো, প্রতারণা ও হ্যাকিংসহ অন্যান্য বহু অপরাধ উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষে বলা দরকার যে, নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রত্যেকটা গর্হিত কর্মকাণ্ডই বর্জন করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে দেশের স্বার্থে কাজ করে, দল-মত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সকলেরই এ দেশকে আরো এগিয়ে নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে এবং পাশাপাশি সরকারকেও নেতিবাচক সবকিছুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিঃস্বার্থে দেশকে এগিয়ে নিতে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মূলত তখনই স্বাধীনতাকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশাগুলো একদিন বাস্তবে পরিণত হবে বলে আশা করা যায়। মো. জাফর আলী শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্যঃ বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ঢাবি শাখা। ইমেইলঃ mdjaforalip5@gmail.com ডেল্টা টাইমস্/মো. জাফর আলী/সিআর/জেড এইচ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |