সংকটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
আবু তালহা আকাশ
|
ফেসবুকে স্ক্রল করছিলাম হঠাৎ একটা নিউজ দেখে রীতিমত চমকে উঠলাম। একটি নিউজ পোর্টালের খবরের হেডলাইন ছিল, "চাকরির বাজারাে পিছিয়ে পড়ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা"। যেখানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে মেধাবীদের আতুর ঘর বলা হয় সেখানকার শিক্ষার্থীরা কিনা চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ছে! এই ভেবেই মূলত চমকে ওঠা। খুবই আগ্রহ নিয়ে নিউজটি পড়তে গেলাম। কিন্তু নিউজের ভেতরের চিত্রটি ছিল অন্যরকম। সেখানে যে বিষয়টি দেখানো হয়েছে তার সারমর্ম হলো,"ভার্চুয়াল মাধ্যমে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষাবর্ষ শেষ করে প্রায় সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে থাকছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স কিংবা মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পরীক্ষা না হওয়ায় চাকরিসহ নানা খাতে তারা পিছিয়ে পড়ছেন"। এদিকে করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে শুরু করে সর্বশেষ ১৬ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। যা মহামারী প্রতিরোধ করতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসে নানাবিধ প্রশ্ন সামনে এসে উঁকি দিচ্ছে। যেখানে দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেওয়ার মাধ্যমে পরের শ্রেণীতে উত্তোলনের ব্যাবস্থা গ্রহণ করছেন। উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে অটো পাসের ব্যাবস্থা গ্রহণ করে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর মহাচিন্তার মধ্যে ব্যস্ত। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় বলতেই যেখানে টিভি/পত্রিকাসহ সকল জায়গায় দেখছি ভর্তি গুচ্ছ পদ্ধতিতে নাকি আলাদাভাবে এসবের আলোচনা সমালোচনা নিয়েই যেন সকলে নানা রকমের জল্পনা কল্পনায় মত্ত। নানাবিধ সময়োপযোগী সিদ্ধান্তও নেয়া হচ্ছে শুধুমাত্র সেশন জট থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য। ![]() আবু তালহা আকাশ সেখানে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের মত হাজারো স্বপ্নবাজ মেধাবী তরুণ তরুণীরা। সাধারণভাবেই আমরা সকলেই জানি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই গ্রাম/মফস্বল এলাকায় এবং নিন্মবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। যদিও আধুনিকতার এই যুগে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের হাতে স্মার্টফোন রয়েছে। তবে তা থাকলেও ক্লাস করার ক্ষেত্রে দেখা যায় একদিকে ইন্টারনেটের উচ্চ মূল্য অন্যদিকে নেটওয়ার্কের নিন্ম গতি। যার দ্বারা অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই ক্লাস করাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। আবার দেখা যাচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীর অনলাইন ক্লাস করার ডিভাইস না থাকার ইউজিসি কর্তৃক ডিভাইস ক্রয়ের জন্য বিনাসুদে ঋণ দেওয়ার কথা বলা হলেও তার কার্যকর পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান নয়, তাহলে কখন এই ডিভাইস ক্রয়ের ঋণ তারা পাবে আর কখন ডিভাইস ক্রয় করবে? অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিভাগের ক্লাসগুলো চলমান রেখেছেন এতে করে ডিভাইস বিহীন শিক্ষার্থীসহ নানাবিধ কারণে ক্লাসের ৫০/৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীই অনলাইন ক্লাসের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে শুধুমাত্র অনলাইন ক্লাসটাকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করলেই কি সকল দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে? নাকি এই ক্লাসের সুফলকে বা কারা পাচ্ছে কতটুকু পাচ্ছে, সিদ্ধান্তটা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে সে বিষয়টির প্রতি নজর দেয়াটাও কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের ভেতরেই পরে! আবার আমরা লক্ষ্য করছি করোনা মহামারীর এই সময়ে ৪৩ ও ৪৪ তম বিসিএস সার্কুলার প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের নাম যেখানে বিসিএস সেখানে অনেক শিক্ষার্থী চতুর্থ বর্ষে এসে আটকে আছে যারা এই সার্কুলারের আবেদনের সুযোগ পেত কিন্তু তারা বড় রকমের একটা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধুমাত্র বিসিএস নয় অনেক চাকরির আবেদন তারা করতে পারছেন না এই কারণে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী আবাসিক হলে থাকার কারণে ক্যাম্পাস খুলে ক্লাস পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না এ ধারা থেকে বের হয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিক্ষা নেওয়া অনুমতি প্রদান করেছে ইউজিসি। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এসকল শিক্ষার্থীরা সেশন জট নামক এক অভিশাপের বোঝা মাথায় চেপে নিচ্ছে। যার ফলে মেধাবী হওয়া শর্তেও, করোনাকালীন অনেকটাই পিছিয়ে পড়ছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায়। অন্যদিকে দেখা যায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী টিউশনী করে/পার্টটাইম জব তথা আত্মনির্ভরশীল হয়েই পড়াশোনা করে থাকে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় একদিকে যেমন তারা তাদের অর্থ উপার্জনের এসকল উৎসগুলো হারিয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে বাসায় বসে এসকল নানা রকম চিন্তায় হতাশার সাগরে ডুব দিয়ে আত্মহত্যার মত মহাপাপও তারা করে বসছে। তাইতো আজ পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহননের খবর। এছাড়াও দেশের সরকার যে বাল্যবিবাহ রোধ করা ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার প্রত্যয়ে মাধ্যমিক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষার আইন জারি করেছেন গ্রামাঞ্চলে তার বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। করোনাকালীন এই সময়টাতে গ্রামের অধিকাংশ মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবক। ছেলে শিক্ষার্থীরা বাবাকে আর্থিক সাপোর্ট প্রদানের লক্ষে নানা রকম কাজ কর্মে আত্মনিয়োগ করেছেন; পড়াশোনার বিষয়টি একেবাড়ে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেই। যার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছেই।এমনকি দীর্ষ প্রায় এক বছরের কাছাকাছি সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঝড়ে পড়ছে হাজারো শিক্ষার্থী। আজ দেশে হাঁট-বাজার, অফিস-আদালত, কলকারখানা, বিভিন্ন রকমের খেলাধুলা আছে যার জন্য গ্যালারী ভর্তি দর্শক জমা হচ্ছে, বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা চলছে এবং সেখানে জনবল নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এমনকি কোনো কিছুই যেখানে করোনাকে বাঁধা হিসেবে মনে করছে না। বিভিন্ন সময়ের অসংখ্য মিছিল মিটিংও আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি টিভি, ফেসবুকসহ স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে। যেগুলোতে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই। অথচ সেখানে একত্রিত হচ্ছে হাজার-হাজার মানুষ। আবার প্রাথমিক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষার্থীরাও রীতিমতো পরের ক্লাসের বই পড়া শুরু করেছে প্রাইভেট/কোচিং সেন্টারগুলোতে। যদিও এবিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতাটা সম্পূর্ণই ভিন্ন। সেখানে শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত তা বোধগম্য নয়। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বর্তমান শিক্ষার্থীদের সেশনজট নিরসন, তাদের পরীক্ষা গ্রহণ, উপরের ক্লাসে উত্তোলনের জন্য কোনোরূপ কার্যকরী পদক্ষেপ না নিয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি নেওয়ার চিন্তায় মত্ত থাকাটা কতটা যুক্তিযুক্ত এবিষয়টিও প্রশ্ন তৈরি হয় মনে! বর্তমান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরাই যেখানে তাদের একটা সেমিস্টার শেষ করতে পারলো না সেখানে নতুন করে প্রথম বর্ষে আবারো ভর্তি নিয়ে তাদেরও গলায় কাটা আটকে দেওয়াটা কতটুকু কার্যকরী? কিন্তু হা এটাও সত্য তাদের ভর্তির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ চলমান যেসকল শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের সেশনজট নামক অভিশাপের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ। তাই বলতে চাই, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি যারা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত বিশেষ করে শেষ বর্ষের দিকে তাদের প্রতি সুনজর দিন। গ্রামে একটি প্রবাদের প্রচলন আছে, "দেশি ফকির ভাত পায় না, বিদেশি ফকিরের আমদানি"। তাই কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ বর্তমান শিক্ষার্থীদের আকুতি আর্তচিৎকারের প্রতি আগে কর্ণপাত করুন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশের মেধাবীদের আতুর ঘরকে এভাবে দিনে দিনে পিছিয়ে যেতে দিবেন না। যদিও সরকারসহ নীতিনির্ধারণকারী মহলের সকলেই শিক্ষার্থীদের ভালোর দিকটি বিবেচনা করেই এখনও পর্যন্ত সবকিছু বন্ধ রাখছেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? কলেরা মহামারিরও একটা সময় ছিল যখন একজন আক্রান্ত হলে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ মরে সাফ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শুধুমাত্র পাঁচ টাকার দুটো স্যালাইন আর দুটো খাবার বড়ি দিয়েই নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে। সেই কলেরা আজও আমরা সথে নিয়েই বেঁচে আছি, হয়তো খুব শিগগিরই করেনার প্রতিষেধকও আবিষ্কৃত হবে কলেরার মত করোনাকেও সাথে নিয়ে আমরা বাঁচতে শিখবো। কিন্তু তার আগে একটি উজ্জ্বল, চকচকে, সোনালী জাতি ধ্বংসের মুখে পতিত হওয়ার আগে তাদের রক্ষা করুন! প্লিজ! (প্রকাশিত
লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, ডেল্টা
টাইমস্ কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার ডেল্টা
টাইমস্ কর্তৃপক্ষ নেবে না। ) আবু তালহা আকাশ সাংগঠনিক সম্পাদক; বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। শিক্ষার্থী,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ। মেইল- abutalhaakash98@gmail.com ডেল্টা টাইমস্/আবু তালহা আকাশ/সিআর/জেড এইচ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |