গণতান্ত্রিক রোডম্যাপ যখন পূর্বপরিকল্পনার অংশ হয়
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() . ওই দিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র এমন এক সময়ে এই নতুন নিষেধাজ্ঞা দিল, যখন জাতিগত সংখ্যালঘু সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সঙ্গে সেনাবাহিনীর গৃহযুদ্ধ তুমুল আকার ধারণ করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের এসব নিষেধাজ্ঞা জান্তা সরকারকে গণতন্ত্রের পথে ফেরাতে পারেনি কিংবা গণতন্ত্রপন্থী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে জান্তা বাহিনীর সমঝোতার পথ তৈরি করতে পারেনি। দুই হাজার দশ সালের আগে মিয়ানমার গণতান্ত্রিক সরকার পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ওই সময়টাতে দেশটির ওপর যেসব মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল, তার সঙ্গে বর্তমানে আরোপ করা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অনেক মিল রয়েছে। দুই হাজার একুশ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং অন্যান্য কিছু দেশ মিয়ানমারের বিভিন্ন খাত ও প্রতিষ্ঠানকে নিশানা করে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তার লক্ষ্য ছিল দেশটির গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারীদের ওপর জান্তার নিপীড়ন রোধ। এবং জান্তার অভ্যুত্থানের পর সামরিক সরকার ও তার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান গুলোকে আর্থিকভাবে কাবু করতে অধিকতর শক্তিশালী অবরোধ আরোপ করা হয়। পূর্ববর্তী সময়ে আর্থিক সাজাগুলো ব্যাপক ছিল এবং সেটি সমগ্র মিয়ানমারের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল। দেশটির ওপর পশ্চিমারা যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা একটি সুনির্দিষ্ট ছক ধরেই দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের ওপর দুই হাজার একুশ-পরবর্তী মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের আইনি ভিত্তি ছিল নির্বাহী আদেশ-'চৌদ্দ হাজার চৌদ্দ'। এই নির্বাহী আদেশটি মিয়ানমারের বিমানবাহিনীকে জেট ফুয়েল সরবরাহ করার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে নিশানা করার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। দুই হাজার তেইশ সালের এগারো ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ধরন দেখলে বোঝা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ধরনে পরিবর্তন এনেছে। ওই নিষেধাজ্ঞায় বাইডেন প্রশাসন স্পষ্টতই আর্থিকভাবে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের জেনারেলদের নিশানা করেছে।মিয়ানমারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক মনোভঙ্গি না নিয়ে সহযোগিতা মূলকভাবে কাজ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এই সমন্বয়ের প্রমাণ মেলে দুই হাজার একুশ সালের দশ ডিসেম্বর। ওই দিন যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইইউর সঙ্গে এক হয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের একটি প্যাকেজ ঘোষণা করে। যেমন ইইউ এই প্যাকেজের আওতায় মিয়ানমারে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি ওপর বিধিনিষেধ, জান্তা কর্মকর্তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, ভিসা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের বিশেষ পদাধিকারী নাগরিকদের তালিকা ধরে একটি কালোতালিকা বানায়। তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে মার্কিন নাগরিকদের সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হয়। এই তালিকায় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও আমলারা রয়েছেন। এর মাধ্যমে পশ্চিম এই বার্তা দিয়েছে যে তারা সামগ্রিক ভাবে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে না। তারা মূলত অভ্যুত্থান এবং গণতন্ত্রের প্রচারকদের দমন-পীড়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও সত্তাকে অর্থনৈতিক যন্ত্রণা দিতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা এর আগেও মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। এসব নিষেধাজ্ঞা এমন কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি যা জান্তাকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করবে। এর আগে জান্তা যে গণতান্ত্রিক রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিল, তা তাদের নিজেদের পূর্বপরিকল্পনারই অংশ ছিল এবং সেটি মোটেও পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার ফল ছিল না। এর একটি বড় কারণ হলো, আগে মিয়ানমারের তৈরি পোশাক ও বস্ত্রের মতো এমন অর্থনৈতিক খাতকে নিশানা করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, যার সঙ্গে জান্তা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল না। ওই নিষেধাজ্ঞা দেশটির বেসরকারি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও জান্তার কিছুই হয়নি। সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞাগুলো সামরিক মালিকানাধীন বা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন উদ্যোগ গুলোকে নিশানা করে আরোপ করা হয়েছে। অবশ্য দুই হাজার একুশ সালের আগের নিষেধাজ্ঞাগুলো যে সমস্যায় পড়েছিল, তার পরবর্তী নিষেধাজ্ঞাগুলোও সেই একই সমস্যায় পড়েছে। যেমন নতুন এই নিষেধাজ্ঞাগুলো জাতিসংঘের সম্মতির বাইরে রয়ে গেছে;কারণ জাতিসংঘ এখনো মিয়ানমারের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। ফলে উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে মিয়ানমারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার একটি বড় পার্থক্য রয়ে গেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে বলে মনে হয় না; কারণ এই পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নিন্দা করতে রাজি হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইস্যুতে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। পশ্চিমারা জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করলেও পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলো ঠিকই বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে এই নিষেধাজ্ঞা কাজে আসছে না। বর্তমানে বাংলাদশসহ বহির্বিশ্বে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোণঠাসা হওয়ার যেসব সংবাদ মিলছে, তা মূলত আঞ্চলিক গেরিলা দলগুলোর দ্বারা ঘটছে। মিয়ানমারে এদের বলা হয় এথনিক আর্মড এথনিক রেজিস্ট্যান্স ফোর্স।পিপলস ডিফেন্স ফোর্স নামে পরিচিত বামার তরুণদের গেরিলা দলগুলোকে ইএও প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র জুগিয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে পিডিএফ অঙ্গীকার করেছে তাতমাদোকে হারাতে পারলে মিয়ানমারের প্রান্তিক জাতিগুলোর এলাকায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে এবং দেশটিকে একটা বিকেন্দ্রীকৃত ফেডারেশন আকারে গড়ে তোলা হবে। আপাতত সেটি একটি স্বপ্ন। তবে সেই স্বপ্নকে মিয়ানমারে একদম অধরা কিছু মনে করা হয় না এখন আর। এই স্বপ্ন সফল হলে কেবল মিয়ানমারই পাল্টাবে না, আশপাশের জাতিরাষ্ট্রগুলোতেও তার ছাপ পড়বে। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, মিয়ামারের চলতি ঘটনাবলিতে চীনের অবস্থান নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি আছে বলে মনে হয়। নেপিডোর এখনকার শাসকদের সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা যে বহুকাল ধরে চীন থেকে এসেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্তত গত তিন বছর চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের জান্তাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রায় শর্তহীনভাবে মদদ দিয়ে গেছে। তবে চীন দেশটির প্রান্তিক সশস্ত্র গেরিলা দলগুলোকেও সহায়তা দেয়। এই সহায়তার ভেতর বুদ্ধি-পরামর্শের বাইরে বাড়তি কিছুও থাকে। যেহেতু মিয়ানমার জুড়ে চীনের বহু ধরনের বিনিয়োগ আছে, সে কারণে বেইজিং বহুদিন হলো এই কৌশলে কাজ করে। তবে দেশজুড়ে সামরিক শাসনবিরোধী সশস্ত্রতা যত বাড়ছে, চীন ইএওর সঙ্গে সম্পর্ক তত আরও নিবিড় করছে। এটা হলো আপাতত মিয়ানমারে চীনের একটি নতুন প্রবণতা। এই কৌশল গ্রহণ করে চীন তাতমাদো-বিরোধীদের এটা বোঝাতে চায়, পশ্চিমের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর দরকার নেই তাদের। বেইজিংয়ের এ রকম সবুজ সংকেত পাওয়ামাত্র ইএওর তিন-চারটি গ্রুপ তাতমাদোর বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আন্তর্জাতিক পরাশক্তি গুলোর মধ্যে মিয়ানমারে চীনের ভূমিকাই সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত। যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্ট নামের আইনি উদ্যোগ ছাড়া মাঠপর্যায়ে গেরিলাশক্তিকে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদসহায়তা দিয়েছে বলে জানা যায় না; বরং বিরোধী দলের ছায়া সরকার এবং যুদ্ধরত গেরিলাদের মধ্যে পশ্চিম থেকে সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারে গভীর হতাশার কথাই শোনা যায়। ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের সামরিক-সংশ্লিষ্টতা বর্তমানে যে মাত্রায় রয়েছে, তাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের সামরিক সহায়তা বাড়ার আপাতত সম্ভাবনা কম বলেই মিয়ানমারের অনেকের অনুমান। অন্যদিকে অতীতের মতো এখনো পরিস্থিতির ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ বেশ প্রবল এবং তারা কোনোভাবে সেই নিয়ন্ত্রণ হারাতে চাইছে না। তবে ইএওগুলোর কয়েকটিতে অনেক আগে থেকে ইউরোপ-আমেরিকার কিছুটা প্রভাব কাজ করছে। বিশেষ করে চিন ও কারেন অঞ্চলে। চিন, কারেন ও কাচিন অঞ্চলে স্থানীয় বাসিন্দারা চার্চগুলোর মাধ্যমে ইউরোপ-আমেরিকার কিছু মানবিক সহায়তা পান বহুকাল ধরে। সেই সূত্রে ভবিষ্যতে এসব জনপদে সাংস্কৃতিক মাত্রায় হলেও চীন-যুক্তরাষ্ট্র কিছু টানাপোড়েন থাকবে। তবে বাংলাদেশের জন্য এবং নিশ্চিতভাবে থাইল্যান্ড-ভারত-লাওসের জন্য এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মিয়ানমার থেকে নতুন করে শরণার্থী এসব দেশে ঢুকবে কি না। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গার ভারে ক্লান্ত হলেও নতুন শরণার্থী আসা নিয়ে নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ প্রকৃতই বাস্তব। সেখানকার সেনাবাহিনী কোণঠাসা হওয়ার মুখে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের ভেতরে মিয়ানমারের প্রদেশগুলো যত বেশি স্বশাসিত চরিত্র নেবে, তত বেশি সেখানে তাতমাদোর বিমান হামলা বাড়বে। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাগুলো সাক্ষ্য দেয়, বিরুদ্ধবাদীদের এলাকায় জ্বালাও-পোড়াও নীতি’তে তাতমাদোর দক্ষতা আছে। ফলে চিন, আরাকান ও কারেন এলাকায় বম্বিং বাড়লে স্থানীয় মানুষেরা আশপাশের দেশগুলোতে ঢুকে জান বাঁচাতে চাইবেন। তবে সেখানকার পরিস্থিতিই বলে দেবে কোনদিকে এগুচ্ছে মিয়ানমার জনগণের ভবিষ্যত। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস্/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |