|
দেশ পুনর্গঠনে দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের বিকল্প নেই
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() দেশ পুনর্গঠনে দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের বিকল্প নেই এই প্রত্যাশা আগেও ছিল। তবে তা ছিল শুধু স্লোগান। প্রায় ৮০০ শহীদ এবং ২০ হাজার মারাত্মক আহত তরুণ ও যুবদের রক্তে রঞ্জিত এই বাংলাদেশকে প্রকৃত স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির দেশ, ভোটাধিকার ও বাক-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। বৈষম্যহীনতা যুগে যুগে সাধারণ মানুষের জীবনে এসেছে। এক সময় অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্র জয় করে সাধারণ মানুষকে শোষণ করা হতো। ভূস্বামীরা জমি দখলকরে সাধারণ মানুষকে বাধ্যতামূলক ভাবে জমিতে চাষ করাতো। ইউরোপে কারখানায় মালিকরা শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাতো, আর তাদের কাজের বিনিময়ে খুব কম মজুরি দেয়া হতো। পুঁজিবাদীশ্রেণী বা মালিকপক্ষ সব সময় শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে শোষণ করতো। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করা, বিরোধী মতকে দমন করা, জনগণকে ভোট থেকে বঞ্চিত করা, সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা এবং শক্তভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখে সমাজ ও অর্থনীতির উপর কর্তৃত্ব করাকে কর্তৃত্ববাদ বা ফ্যাসিবাদ নামে অভিহিত করা হয়। অপরদিকে, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাষ্ট্রকে বুঝায় যা জনগণের সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা দান করে। কল্যাণ রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য হল-জনকল্যাণ সাধন, নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা দান, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও বৈষম্য দূর, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জনগণের মৌলিক অধিকার ও চাহিদা পূরণ করা ইত্যাদি। জাতিসংঘের ঘোষণা মতে, কোন রাষ্ট্রকে তখনই কল্যণমূলক রাষ্ট্র বলা যেতে পারে যখন রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে এবং বেকারত্ব, অসুস্থতা অথবা অন্য কোনো কারণে জীবিকার্জনের অক্ষমতায় সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে,টমাস পেইনের মতো সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিকরা ন্যায়সঙ্গত সমাজের পক্ষে ছিলেন। তারা এমন একটি রাষ্ট্র বিনির্মানের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে রাষ্ট্র নিজেই সক্রিয়ভাবে তার নাগরিকদের কল্যাণ সুনিশ্চিত করবে। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ সংস্কারক উইলিয়াম বেভেরিজ আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রসমূহ যেমন-যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস এবং এশিয়া মহাদেশের জাপান এবং সিঙ্গাপুরও তাদের স্বতন্ত্র সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বিভিন্ন মডেল গ্রহণ করেছে। ইহা একটি ভালো সরকার ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি নাগরিকের সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। প্রতিটি জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র নাগরিকদের ন্যায়বিচার, সাম্য, সমমর্যাদা, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি সুনিশ্চিত করে। বাংলাদেশে জুলাই এবং আগস্ট মাসে যে আন্দোলন হয়, তা ছিল মূলত কোটা বিরোধী আন্দোলন অর্থাৎ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ৫৬ শতাংশ চাকরির কোটাবিরোধী আন্দোলন ছিল। যেসব ছাত্র-ছাত্রী স্নাতকসম্পন্ন করে চাকরি খুঁজছিল, তারা বছরের পর বছর চেষ্টা করেও কোন চাকরি পাচ্ছিল না এবং বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছিল। তাদের কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়। অতঃপর আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এক দফার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের এই বৈষম্যপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করে একটি সার্বজনীন কারিকুলাম ও নিরপেক্ষ পরীক্ষা পদ্ধতি অবিলম্বে চালু করা প্রয়োজন, যাতে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যরা চাকরি পায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমাদের দেশে শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ জাতীয় আয়ের দেড় থেকে দুই শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশে তিন থেকে চার শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করা হয়। যা সত্যিই দুহখজনক। শুধু তাই নয়,দেশের প্রধান উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠে শুধুমাত্র দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলে জাতির নিরপেক্ষতার জায়গা কোথায় থাকবে, তা ভাববার বিষয়। তদুপরি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আবাসিক সমস্যা, দীর্ঘদিন ছাত্রলীগ কর্তৃক দখলদারিত্ব, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিমিত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার অভাব, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অভাব, সঠিক ও যোগ্য ছাত্রনেতা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। সুতরাং জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১০৩টি। গত ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় বিবেচনায় পরিচালনা পর্ষদ, প্রশাসনিক নেতৃত্ব বিশেষ করে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার নিয়োগ দেওয়া হয়। সর্বোপরি গত ১৫ বছরে এ দেশে শিক্ষামানের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে যা সংস্কার করা একান্ত প্রয়োজন গত ১৫ বছরে বিচারালয় পুরোটাই আওয়ামী দলীয় বিচার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। বিচারপতি, এটর্নি জেনারেল এবং আইনজীবী সমিতি সবই দলীয়করণ করা হয়েছে। যোগ্যতা, মেধা, নিরপেক্ষতা ও আইনগত দক্ষতা বিবেচনা করে বিচারপতি ও সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। প্রতিটি অপরাধীকে বিচারের সম্মুখীন করা আবশ্যক। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও গত ১৫ বছরে আওয়ামী সংস্থায় পরিণত হয়েছে। সরকার বিরোধীদের দমনই ছিল এর প্রধান কাজ। জেল-জুলুম, বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমিতিতে বাধা, গুম, খুন এবং বিরোধীপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে আইন প্রয়োগকারীর কাজ করেছে। পুলিশ বাহিনী, র্যাব, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড, আনসার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। আয়না ঘর তৈরি করে সেখানে বিরোধীদলের নেতাদের বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়, যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিশেষ করে র্যাব গত ১৫ বছরে যে ভূমিকা রেখেছে, তাতে র্যাবকে বিলুপ্তি ঘোষণার দাবি উঠেছে। যেসব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হত্যা ও গুমের সাথে জড়িত তাদের বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশেষ কমিশন গঠন করে ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বিরোধী দলের উপর নিপীড়ন এবং ভোটের কারচুপিতে সহায়তা কারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। নিরপেক্ষও যোগ্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নির্বাচন কমিশনার ও সদস্য নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন দেয়া উচিত, যাতে প্রতিটি নাগরিক তার ভোটাধিকার ফিরে পায়।জাতীয় সংসদ গঠনমূলক ও জনপ্রতিনিধিদের মতামতেই পরিচালনা করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীনতার জন্য শেখ হাসিনা কর্তৃক পরিচালিত সরকার ব্যবস্থা দায়ী। এদেশে ১৯৯০ সাল থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত মন্ত্রি পরিষদ সরকার ছিল, যা প্রকারান্তে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বপূর্ণ সরকার। কিন্তু এই সরকার ব্যবস্থা জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখেনি। বিশেষ করে ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। সুতরাং মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার সংস্কার দরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হল বৈষম্যহীন কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান সংস্কার করা। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা চালু করা। যেখানে উচ্চকক্ষ সিনেট এবং নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ নামে পরিচালিত হতে পারে। উচ্চকক্ষ প্রেসিডেন্টের কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং নিম্নকক্ষ জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা আইন প্রণয়ন করবে। তাহলে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, জাতীয় সংসদ ও সিনেটের কর্তৃত্বে থাকবেন এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখবেন। পক্ষান্তরে, জুলাই-আগস্ট এর সকল গণহত্যার বিচার করা এবং শহীদদের রক্তে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা সার্থক করার জন্য জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই কেবল বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ তথা আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব। যে রাষ্ট্র দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দেবে। অসহায় নারী, প্রবীণ, বেকার ও প্রতিবন্ধীরা ভাতা প্রাপ্ত হবে এবং প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়া হবে। আজ এবং আগামীতে এভাবে জনগণের সন্তোষ জনক জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দিতে পারে নতুন সরকার। যদিও কাজগুলো সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন। কেবলমাত্র দুর্নীতিমুক্ত সরকারি ব্যবস্থাপনা, দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব এবং জনগণের অংশগ্রহণে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |