|
শিক্ষা খাত বারবার হোঁচট খাওয়া কোনভাবেই কাম্য নয়
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() শিক্ষা খাত বারবার হোঁচট খাওয়া কোনভাবেই কাম্য নয় একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বয়স ৫৩ বছর। এই সময়ে রাষ্ট্রের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কার্যগুলো সম্পাদন করা সহজ ব্যাপার নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি কল্যাণমূলক আধুনিক রাষ্ট্রের যে সকল উপাদান থাকা উচিত, তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন অনেকটা সময়। একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে সময়টা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। তবে একটি রাষ্ট্র কতটুকু উন্নত হবে অথবা তার ভবিষ্যৎ কোনদিকে এগোচ্ছে তা বোঝা যায় তার শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে। সেক্ষেত্রে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রের বর্তমান অবস্থা দেখে উপলব্ধি করা সম্ভব। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় অতীতের বছরগুলোতে যাবতীয় পাবলিক পরীক্ষায় ব্যাপক হারে নকল এবং দুর্নীতি হয়েছিল। এটি ছিল রাষ্ট্রের জন্য বিষবৃক্ষের প্রথম চারা রোপন। এই ঘটনাটির প্রভূত ক্ষতি একদিনে মুছে ফেলা যাবে না এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আমাদের বয়ে চলতে হবে পাবলিক পরীক্ষায় দুর্নীতির মনোভাব। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান যে লক্ষ্য ছিল জাতিকে মেধাশূণ্য করে দেয়া তা অনেকাংশেই সফল হয়েছে বলা চলে। ঐ সকল বুদ্ধিজীবীদের অবর্তমানে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম চলে গিয়েছিল অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে। বাংলাদেশ যে সূচনালগ্নে একেবারে বুদ্ধিজীবীশূণ্য অবস্থায় ছিল, তা বলছি না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অনেককেই হারাতে হয়েছে। যা চলে গেছে তা নিয়ে ভেবে অবশ্য সবিশেষ লাভ নাই। তবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন যে প্রয়োজন তা নিয়েও ভাবতে হবে।গুণগত মান যাই হোক, সংখ্যাগত মান বাড়াতে হবে। দেখাতে হবে শিক্ষার্থী কতটা শিখেছে তা নয়, কত বেশি শতাংশ পাস করেছে। এরই ফলস্বরূপ শিক্ষার হার বছর বছর বৃদ্ধি পায়। ১৯৯১ সালে যা ছিল ৩৫.৩২ শতাংশ, ২০২১ সালে এসে তা হয়েছে ৭৬.৩৬ শতাংশ। তবে সমতুল্য দেশগুলোর মধ্যে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানে এ হার শতভাগ। শ্রীলঙ্কায় ৯২.৪৩ ও কঙ্গোতে ৮০.৬১ শতাংশ। যা হোক, গুণগত মান বিচারে বিশ্বায়নের এই যুগে টিকে থাকার জন্য আমরা কতটা যুগোপযোগী। আমরা যে শিক্ষক প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরে পাচ্ছি তারা কত শতাংশ সত্যিকারের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানসম্পন্ন বা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন? সদর্থক কোনো উত্তর নেই। শিক্ষার ধরন নিয়েও কোনো সামঞ্জস্য নেই। যেমন কোনো এক সরকার বলল, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এই জ্ঞান থাকলে বেকার থাকবে না। শুরু হলো মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া। অবকাঠামো উন্নয়ন, যন্ত্রপাতি ক্রয়, টেকনিক্যাল শিক্ষা ইত্যাদি মহাকর্মযজ্ঞ। কয়েক বছর পর দেখা গেল শতাংশের হারে মেলানো যাচ্ছে না। কোথায় যন্ত্রপাতি, ফ্যান, চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাব তার কোনো হদিস নেই। আবার কোনো সরকার সিদ্ধান্ত নিল, শুধু কারিগরি শিক্ষা হলেই চলবে না; পাশাপাশি ব্যবসা শিক্ষার দরকার আছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। তার মানে আবার আরেকটা মেগা প্রকল্প হাতে নিতে হবে। কারণ শিক্ষা বলে কথা। মেগা প্রকল্প ছাড়া তো আর চলবে না। বলা হলো, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তাই পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করা দরকার, যাতে পরীক্ষাভীতির কারণে ছাত্রছাত্রীরা ঝরে না পড়ে। কিছু জানল বা শিখল কিনা, তার দরকার নেই। অটো পাস দেওয়া হোক। আবার সিদ্ধান্ত হলো, কারিগরি, ব্যবসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের আইটি বিশেষজ্ঞ হতে হবে। সুতরাং নতুন নতুন প্রকল্প। সব শিক্ষার্থীর হাতে ট্যাব, মোবাইল ফ্রি দেওয়া হবে। ছাত্রছাত্রীদের শাসন করা যাবে না। বাবা সোনা বলে বলে শেখাতে হবে। খুবই সুন্দর। তার জন্যও প্রকল্প। তা হলো, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের খুঁজে স্কুলে আনতে হবে। তাদের দুপুরবেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা দরকার। এসব কারা করবে? শিক্ষকরা করবেন। কিন্তু যারা স্কুলে উপস্থিত আছে তাদের পাঠদান কারা কখন করবেন, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। যেহেতু শিক্ষকরা ব্যস্ত, সেহেতু উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা কী করবে? কেন, খেলাধুলা করবে! স্বাস্থ্য সুখের মূল। আবার শুনছি ধর্মীয় শিক্ষা যেটুকু আছে এতে কাজ হবে না। আরও বিস্তারিত জানতে হবে। সামাজিক অবক্ষয়ে যে দেশের মানুষ নিমজ্জিত। এর মধ্যে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা বিদ্যমান। সুতরাং প্রকল্প হাতে নেওয়া প্রয়োজন। এভাবে শিক্ষা খাত বারবার হোঁচট খাচ্ছে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। আমাদের দেশে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার সুযোগ কত শতাংশ পাচ্ছে? সেই সব ছাত্রছাত্রীর কত জন দেশে থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে? সবাই বিদেশমুখী। একবার বিদেশে পড়তে গেলে তারা আর দেশে ফেরে না। তাহলে দেশ আজ কেমন প্রজন্ম উপহার পাচ্ছে।অন্যদিকে কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। এখন তো কোচিং সেন্টারগুলোই আসল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সেটা ইংরেজি, বাংলা উভয় মাধ্যমেই। এখন ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে কোচিংয়ের প্রতি ঝোঁক বেশি। স্কুলের শিক্ষার প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণ বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। শিক্ষকরাও তাদের কোচিং সেন্টারের প্রতি বেশি মনোযোগী। তাহলে তো শিক্ষা সেবা নয়, বাণিজ্য। শিক্ষাকে বাণিজ্য নয়, সেবা মনে না করলে আজকের এই কিশোর গ্যাং, মাদকাসক্ত, ছাত্রাবস্থায় ক্ষমতার দাপট দেখানো, সহজ পন্থায় বেশি অর্থ উপার্জন, রাতারাতি ধনী হওয়ায় প্রবণতাসহ সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় এসব বাড়তে থাকবে। দেশের বাইরে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকবে। আসলে প্রয়োজন হলো, দেশে অবকাঠামোসহ যা যা ব্যবস্থা আছে সেগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা, পাশাপাশি শিক্ষা খাতে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্য হতে না দেওয়া। তা ছাডা শিক্ষকের উপযুক্ত বেতন-ভাতা ও সামাজিক মর্যাদার ব্যবস্থা করা। তাহলেই সুশিক্ষা অনেকাংশে নিশ্চিত হবে।আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এই অবস্থা সত্যি উদ্বেগজনক। রাষ্ট্র অচিরেই কূলহারা পরিস্থিতিতে পড়বে বলে মনে হয়।এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শিক্ষিত প্রতিটি নাগরিককে উদ্যোগী হওয়া উচিত। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে স্ব-প্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসা উচিত। তবে প্রধান দায়িত্বটি অবশ্যই পালন করতে হবে সরকারকে। আধুনিক রাষ্ট্র ধারণায় সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। রাষ্ট্রের উন্নতি বা অবনতির পেছনে সরকারের দায়-দায়িত্বই বেশি থাকে। তাই আমাদের দেশের শিক্ষার মান উন্নয়নে করণীয় দিকগুলো খুজে বের করতে হবে। তবে শিক্ষার মান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি কাজটি করতে হবে সরকারকে। কেবল অর্থের যোগানই নয় বরং চিন্তাগত পর্যাপ্ত সার্পোট নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও একটি পূর্ণাঙ্গ এবং দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। এবং সেই শিক্ষানীতির যথাযথ বাস্তবায়নের অবকাঠামোগত কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে।প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরা বই বুকে জড়িয়ে হাসিমুখে ফসলের খেতের পাশ দিয়ে স্কুলে যাওয়ার দৃশ্যটি সত্যি অসাধারণ। এমনটি আমাদের দেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা জাগায়। সুতরাং এই দৃশ্যটিকে যথার্থ করে তোলার জন্য সরকার ও দেশের প্রতিটি নাগরিকের সচেষ্ট হয়ে সুশিক্ষার ব্যবস্থার জন্য বর্তমান সঙ্কটগুলোকে নিরসন করতে উদ্যোগী হতে হবে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |