শাহবাগী: একটি রাজনৈতিক পরিচয়ের উত্থান ও পতন
জারিন নাজনীন
|
![]() . এর উত্তর জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে এক যুগ পূর্বে, ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি, যেদিন জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধের মামলার বিচারে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (বাংলাদেশ), যার সৃষ্টিই হয়েছিল যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য। আব্দুল কাদের মোল্লার বিচারের এই রায়কে ঘিরেই সূচনা হয় শাহবাগে 'গণজাগরণ মঞ্চ' নামক আন্দোলনের। আন্দোলনকারীরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়টি প্রত্যাখ্যান করে ফাঁসির দাবি জানায়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কি আসামির পক্ষে রায় দিয়েছিল? ন্যায্য বিচার কি করেনি?এর উত্তর জানতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে, যেখানে আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী ইশতেহারই ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। নির্বাচনে জয়ের পর শেখ হাসিনা সরকার ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করে। বিচারকাজে হাসিনা সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ, অভিযুক্তদের যথেষ্ট সময় ও নিজেদের পক্ষে পর্যাপ্ত সাক্ষী-প্রমাণ পেশ করতে না দেওয়া, অনিরপেক্ষ বিচারক, বিচারকাজে অভিযুক্তদের নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করে দ্রুত রায় আদায় করে নেওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। অথচ আসামি পক্ষের এত সব প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এবং হাসিনা সরকারের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা থাকার পরও, যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দান করে, সেই ন্যায্য বিচার প্রত্যাখ্যান করে এবং চাপ প্রয়োগ করে আইন পরিবর্তন করে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি আদায়কারী জনতাই হলো শাহবাগী। শাহবাগের আন্দোলনটি শুরুতে কিছু ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মাধ্যমে সূচিত হয় এবং পরবর্তীতে সারা দেশে পরিচিতি লাভ করে। এই আন্দোলন সারাদেশে প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে সংবাদমাধ্যমগুলো। গুটিকয়েক পত্রিকা ছাড়া, অন্যান্য পত্রিকাগুলো ঢালাওভাবে শাহবাগীদের পক্ষে প্রচার শুরু করে। টিভি চ্যানেলগুলো সর্বক্ষণ ক্যামেরা নিয়ে শাহবাগে দাঁড়িয়ে থাকত। এসব সংবাদমাধ্যম শাহবাগীদের বয়ানকেই প্রচার করত, কিন্তু সত্য ঘটনা কী ঘটছে তা তুলে ধরত না। এবার কথা বলা যাক কিছু অতি পরিচিত শাহবাগীদের নিয়ে। শাহবাগের প্রাণপুরুষ ছিলেন ইমরান এইচ সরকার। ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা ছাড়াও ইমরান এইচ সরকারের সাথে ছিলেন মুন্নি সাহার মতো গণমাধ্যম কর্মীরা, সিপিবির মতো বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো, জাফর ইকবালের মতো বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লাকির মতো স্লোগানকন্যাসহ আরো অনেকে; বাদ যায়নি শিশুরাও। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত শাহবাগীদের এই আন্দোলনে শিশুদেরকেও সামিল করা হতো, এবং শিশুদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন সময় আপত্তিকর ও হিংস্রাত্মক স্লোগান দেওয়া হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, “রাজাকারের চামড়া, কুত্তা দিয়া কামড়া” স্লোগানটির কথা। যেহেতু শাহবাগীদের অন্যতম দাবি ছিল জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ ও জামায়াত-শিবির সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান বয়কট করা, তাই শাহবাগীদের স্লোগানগুলোর মধ্যে অনায়াসে ঠাঁই করে নেয় “একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর”-এর মতো নৃশংস স্লোগানও। শুরুতে ইমরান এইচ সরকারের সাথে ছিলেন বিভিন্ন ব্লগাররা, যাদের মধ্যে অনেকের নেশাই ছিল ইসলাম ধর্মবিরোধী ও অবমাননাকর লেখা রচনা করা। ব্লগারদের ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিরূপ মন্তব্য, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কুৎসা রটনা ও অবমাননাকর লেখালেখির কারণে দেশে ধর্মীয় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ব্লগারদের বিরুদ্ধে নাস্তিকতা ও ধর্ম অবমাননার অভিযোগের জেরে পরবর্তীতে কয়েকজন ব্লগারের ওপর হামলাও করা হয়; এতে নিহত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে, যেমন ব্লগার রাজীব হায়দারকে হামলা করে হত্যা করা হয়। শাহবাগীদের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তীতে ঘটে যায় শাপলা চত্বরের গণহত্যার মতো নিকৃষ্ট এক ঘটনাও। ২০১৩ সালের ৫ মে, শাহবাগীদের আন্দোলন ও ইসলাম অবমাননার বিপরীতে ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে ঢাকার মতিঝিলে সমাবেশ ডাকে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই সমাবেশে ব্যাপক সহিংসতা আর ভয়াবহ তাণ্ডব চালায়। সেই তাণ্ডবের ওখানেই শেষ নয়—সেই রাতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরো মতিঝিল এবং আশেপাশের এলাকার বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে যৌথ অভিযান করে, রাতের অন্ধকারে চালায় গণহত্যা। ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’ নামের সেই কলঙ্কময় অভিযানে কতজন নিরীহ সাধারণ মাদ্রাসার শিক্ষক, আলেম, কুরআনের হাফেজ, এতিম ও মাদ্রাসার ছাত্রকে হত্যা করা হয়, সেই সংখ্যা দেশবাসী আজও জানতে পারেনি। শাপলা চত্বরে ঘটে যাওয়া এই ঘৃণ্য গণহত্যায় উল্লাস, আনন্দ ও গর্ববোধ করেছে যারা—তারাই ছিল শাহবাগী। এই শাহবাগীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক শাহবাগীর ক্রমান্বয়ে শাহবাগ আন্দোলনের আদর্শ নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগতে থাকে। পরিশেষে, যখন তাদের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের আন্দোলনের পিছনের ভয়ঙ্কর চরিত্রটি ধরা পড়ে, তখন তারা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে সরে যায়। তাদের অনেকেই পরবর্তীতে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। উদাহরণস্বরূপ, সবার পরিচিত পিনাকী ভট্টাচার্যের কথা বলা যায়। কমিউনিস্ট পার্টি অফ বাংলাদেশ (সিপিবি)-এর পূর্ণ সদস্য হওয়ায় শাহবাগের আন্দোলনের প্রথম সারির একজন শাহবাগী ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে শাহবাগের আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি সিপিবির ফোরামে প্রশ্ন তুলতে থাকেন। ৫ই মে’র শাপলা গণহত্যার পর তিনি প্রকাশ্যে শাহবাগ আন্দোলনের সমালোচনা শুরু করেন। আর তখনই সিপিবি দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বসবাস শুরু করেন এবং সেখান থেকেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে তার কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান যেন শাহবাগীদের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ই আগস্ট স্বৈরাচারী সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান ভারতে। এরপর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় এবং তারা অস্থিতিশীল বাংলাদেশের হাল ধরে। দ্রুতই যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্য, ব্যাংকিং সেক্টর, আইন-শৃঙ্খলা, বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রশাসন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা ও পাশাপাশি অন্যান্য সংস্কারকাজে এগিয়ে যেতে থাকে, তখন ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর শাহবাগীরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের অগ্রগতিকে ব্যাহত করার জন্য তাদের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা শুরু করে। তবে তারা ভুলে গেছে যে, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ আর আগের মতো নেই। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ শাহবাগীরা প্রতিনিয়ত হাতেনাতেই পাচ্ছে। যেমন—হাসিনা পলায়নের পর ঢাকা কাওরান বাজারের সবজি বিক্রেতারা মুন্নি সাহাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছিল; শ্লোগানকন্যা লাকিকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জন্য মিছিল হয়েছে; জাফর ইকবালের বই প্রকাশনী ও পাঠকরা প্রত্যাখ্যান করেছে; এবং অনেক শাহবাগীকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রকৃতির প্রতিশোধ কি সুন্দর! যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ব্যবহার করে স্বৈরাচারী সরকার ও শাহবাগী ইমরান এইচ সরকাররা শাহবাগ আন্দোলনের এই কালো অধ্যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সৃষ্টি করেছে, সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালই গত ১২ই মার্চ শেখ হাসিনা ও ইমরান এইচ সরকারসহ শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যার ঘটনায় কতিপয় অপরাধীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। ২০১৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলাম। যেহেতু শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ছিল, সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যাওয়ার পথে শাহবাগের আন্দোলনটি আমার চোখে পড়ত। তবে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় রাজনৈতিক সচেতনতা আমার মধ্যে গড়ে ওঠেনি, তাই গণজাগরণ মঞ্চের দূরভিসন্ধি আমার চোখে পড়েনি। আমার মতো বাংলাদেশের অনেক সাধারণ জনতার চোখেও পড়েনি। প্রশ্ন হতে পারে, কিভাবে শাহবাগীরা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে সাধারণ মানুষদের চোখে ধুলো দিতে সক্ষম হয়? এর উত্তর দিতে পারে বাংলাদেশের মিডিয়া। গুটিকয়েক সংবাদমাধ্যম ছাড়া, বাকি সব পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মিডিয়া ফ্রেমিং করে শাহবাগীদের বয়ানকে আমাদের সামনে সত্যি বলে প্রচার ও প্রসার চালায়। সংবাদমাধ্যমের প্রধান কাজ হচ্ছে সত্য তথ্য খুঁজে বের করে তুলে ধরা, কিন্তু তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে রচনা শুরু হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়; আর সেই সাথে আইনের বিচারকে তোয়াক্কা না করে ফাঁসির রায় ও গণহত্যা করতে জন্ম নেয় শাহবাগীরা। লেখক: নাগরিক সাংবাদিক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডেল্টা টাইমস/জারিন নাজনীন/সিআর |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |