নতুন আশা ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে নোবেল প্রাইজ
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() নতুন আশা ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে নোবেল প্রাইজ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সাধারণত অত্যন্ত সতর্ক থাকে। এটি বাইরের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা অন্যান্য রোগজীবাণুকে আক্রমণ করে এবং শরীরের নিজস্ব সুস্থ কোষ ও টিস্যুকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে। এ ক্ষমতাকে বলা হয় টলারেন্স বা সহনশীলতা। তবে যখন এ টলারেন্স ভেঙে যায়, তখন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলবশত শরীরের নিজস্ব কোষ ও টিস্যুকে আক্রমণ করতে শুরু করে, যা অটোইমিউন রোগ সৃষ্টি করে। অটোইমিউন রোগ হলো এমন এক ধরনের অবস্থা যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে নিজস্ব সুস্থ কোষ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করে, ফলে প্রদাহ ও ক্ষতি সৃষ্টি হয়। বর্তমানে ৮০টির বেশি অটোইমিউন রোগ সম্পর্কে জানা গেছে, যেমন-ডায়াবেটিস, মাল্টিপল স্কলেরোসিস এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। ব্রানকো, রামসডেল ও সাকাগুচির গবেষণা প্রমাণ করে যে শরীরের প্রধান রোগ প্রতিরোধ অঙ্গ থাইমাস গ্রন্থির বাইরেও পেরিফেরাল টিস্যু বা অঙ্গগুলোয় একটি শক্তিশালী দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজ করে। এ প্রক্রিয়াটিই পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স নামে পরিচিত। মেরি ই. ব্রানকো এবং ফ্রেড রামসডেল দেখিয়েছেন যে কিছু নির্দিষ্ট জিন রোগ প্রতিরোধ কোষগুলোকে শরীরের নিজস্ব সুস্থ কোষ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রমণ না করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। তাদের গবেষণা স্পষ্ট করে যে এ জিনগুলোর ত্রুটিই কীভাবে মারাত্মক অটোইমিউন রোগ সৃষ্টি করতে পারে। শিমন সাকাগুচি নিয়ন্ত্রক টি-কোষ নামে এক বিশেষ ধরনের শ্বেত রক্তকণিকার গুরুত্ব আবিষ্কার করেন। এ কোষগুলোই হলো পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্সের মূল নিয়ন্ত্রক। নিয়ন্ত্রক টি-কোষগুলো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অতিরিক্ত সক্রিয়তাকে দমন করে, যেন তারা সুস্থ কোষ বা টিস্যুকে আক্রমণ না করে। সাকাগুচির এ আবিষ্কার অটোইমিউন রোগ, অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের এসব মৌলিক গবেষণা আবিষ্কার কেবল অটোইমিউন রোগের চিকিৎসাই নয়, বরং ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির পর অঙ্গ প্রত্যাখ্যান রোধ করা এবং ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইমিউন সিস্টেমকে আরো কার্যকরভাবে পরিচালনা করার নতুন উপায় দেখিয়েছে। চলতি বছরে রসায়নে নোবেল পুরস্কার যৌথভাবে দেয়া হয়েছে জাপানের সুসুমু কিতাগাওয়া, অস্ট্রেলিয়ার রিচার্ড রবসন এবং ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন-জর্ডানীয় বিজ্ঞানী ওমর এম ইয়াঘিকে। তাদের এ সম্মাননা দেয়া হয় ধাতব-জৈব কাঠামোর উদ্ভাবন ও সংশ্লেষণের জন্য। রসায়নে এ নতুন শ্রেণীর জৈব অণুর নকশা তৈরির ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক স্থাপত্যের জন্ম দিয়েছে, যা মানবজাতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশুদ্ধ জলের ঘাটতির মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধাতব-জৈব কাঠামো হলো এমন এক ধরনের ছিদ্রযুক্ত, স্ফটিকাকার পদার্থ, যা ধাতব আয়ন বা ক্লাস্টারকে জৈব লিগ্যান্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করে তৈরি করা হয়। এদের কাঠামোতে অবিশ্বাস্যভাবে বড় এবং সুনির্দিষ্ট আকারের ফাঁপা স্থান থাকে, যা তাদের কার্যকারিতার মূল চাবিকাঠি। কিতাগাওয়া এবং রবসন এ কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম দিককার অগ্রদূত ছিলেন। রবসন এমন জটিল ত্রিমাত্রিক কাঠামো তৈরির পথ দেখিয়েছিলেন, যেখানে জৈব অণু ও ধাতব আয়নগুলো পুনরাবৃত্তিক নকশায় বিন্যস্ত হয়। কিতাগাওয়া এ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে ধাতব-জৈব কাঠামো সংশ্লেষণ এবং এদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা শুরু করেন। তারা দেখিয়েছিলেন যে কীভাবে এ ছিদ্রযুক্ত কাঠামো বিভিন্ন গ্যাস বা রাসায়নিক অণুকে শোষণ ও ধারণ করতে পারে। প্রফেসর ইয়াঘি এ ক্ষেত্রটিকে শিল্প পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য পরিচিত। তিনি কেবল ধাতব-জৈব কাঠামোর সংশ্লেষণের পদ্ধতিকে উন্নতই করেননি, বরং তিনি জিওলাইটিক ইমিডাজোলেট ফ্রেমওয়ার্কসসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতব-জৈব কাঠামো তৈরি করেছেন, যা তাদের স্থায়িত্ব ও ব্যবহারের পরিসর বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার যৌথভাবে দেয়া হয়েছে ব্রিটিশ জন ক্লার্ক, ফরাসি মিশেল এইচ ডেভোরেট এবং মার্কিন জন এম মার্টিনিসকে। বৈদ্যুতিক সার্কিটে ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং ও শক্তি পরিমাপ আবিষ্কারের জন্য এবারের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন তারা। এ যুগান্তকারী কাজটি দেখিয়েছে যে কোয়ান্টাম মেকানিকসের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যগুলো যা সাধারণত কেবল অতি ক্ষুদ্র কণার মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে করা হতো তা মানব হাতের আকারের একটি বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাতেও প্রদর্শন করা যেতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিকস হলো প্রকৃতির সেই মৌলিক নিয়ম, যা পারমাণবিক এবং উপপারমাণবিক কণাগুলোর আচরণ ব্যাখ্যা করে। এ জগতের সবচেয়ে উদ্ভট বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: কোয়ান্টাম টানেলিং: কোয়ান্টাম জগতে, একটি কণা যথেষ্ট শক্তি না থাকা সত্ত্বেও একটি বাধা বা দেয়াল ভেদ করে অন্যদিকে চলে যেতে পারে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি বলকে দেয়ালে ছুড়ে মারলে তা যেমন নিশ্চিতভাবে ফিরে আসে, ক্ষুদ্র কণার ক্ষেত্রে তা সব সময় ঘটে না। এবং শক্তি কোয়ান্টাইজেশন: কণাগুলো কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণের শক্তি শোষণ বা নির্গমন করতে পারে। নোবেল বিজয়ীরা একটি সুপার কন্ডাক্টিং বৈদ্যুতিক সার্কিট ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে এ আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ঘটনাগুলো একটি বৃহৎ, মানবসৃষ্ট সিস্টেমেও ঘটতে পারে। তাদের এ পর্যবেক্ষণই ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং নামে পরিচিত। তারা আরো প্রমাণ করেন যে এ বৃহৎ সিস্টেমটি কেবল নির্দিষ্ট বা কোয়ান্টাইজড পরিমাণের শক্তিই শোষণ বা নির্গত করে। এ ফলাফল কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। তাদের যুগান্তকারী আবিষ্কার ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ভিত্তি স্থাপন করে। কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ আবিষ্কারের গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। সুতরাং পদার্থবিজ্ঞানে বিজ্ঞানীত্রয়ের আবিষ্কারের প্রধান প্রায়োগিক দিকগুলো হচ্ছে-মৌলিক জ্ঞান: এ গবেষণা প্রমাণ করে যে কোয়ান্টাম মেকানিকস কেবল ক্ষুদ্র কণার জন্য নয়, বরং বৃহৎ মাপের বস্তুগুলোর সামগ্রিক আচরণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে, কৃত্রিম পরমাণু: বিজয়ীদের তৈরি এই সুপারকন্ডাক্টিং সার্কিটগুলোকে এক ধরনের কৃত্রিম পরমাণু হিসেবে দেখা যেতে পারে যা তারবিহীন অবস্থায় কোয়ান্টাম আচরণ প্রদর্শন করে এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: জন এম মার্টিনিস পরবর্তী সময়ে এই কোয়ান্টাইজড অবস্থাগুলোকে কাজে লাগিয়ে কোয়ান্টাম বিট (কিউবিট) তৈরি করার পথ দেখান। কিউবিট হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মৌলিক তথ্য বহনকারী একক। সুপারকন্ডাক্টিং সার্কিট ব্যবহার করে তৈরি কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং মার্টিনিস ও তার সহকর্মীদের কাজটি এ প্রযুক্তির জন্য মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করেছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রচলিত কম্পিউটারের চেয়ে অনেক দ্রুত ও শক্তিশালী হিসেবে কাজ করে। এ প্রযুক্তি গবেষণা, ক্রিপ্টোগ্রাফি, মেশিন লার্নিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো ক্ষেত্রগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। এ তিন বিজ্ঞানীর কাজ কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যাকে পরীক্ষাগার থেকে ব্যবহারিক জগতে নিয়ে এসেছে, যা ভবিষ্যতে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে চলেছে। ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার মারিয়া কোরিনা মাচাদো। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য দীর্ঘদিনের সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে ভেনেজুয়েলার এই রাজনীতিককে এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে একজন সাহসী এবং নিবেদিতপ্রাণ শান্তির চ্যাম্পিয়নকে, একজন নারীকে যিনি অন্ধকারের মধ্যে গণতন্ত্রের শিখা জ্বলিয়ে রেখেছেন। সাহিত্যে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেলেন হাঙ্গেরির লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান এ পুরস্কারের জন্য তাঁকে মনোনীত করার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি বলেছে, তাঁর সৃষ্টিকর্ম আকর্ষণীয় ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, যা মহাপ্রলয়ের ভয়ের মধ্যেও শিল্পের শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।নোবেল কমিটি বিবৃতিতে বলেছে, লাসলো ক্রাসনাহোরকাই মধ্য ইউরোপীয় পরম্পরার একজন মহান মহাকাব্যিক লেখক, যাঁর ধারায় বিস্তার রয়েছে কাফকা থেকে থমাস বার্নহার্ড পর্যন্ত এবং যিনি অসংগতি ও অতিমাত্রায় অতিরঞ্জনের জন্য পরিচিত। তবে তাঁর কাজের পরিধি আরও বিস্তৃত। তিনি প্রাচ্যকেও খুঁজে বেড়ান এবং আরও মননশীল, সূক্ষ্মভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুর গ্রহণ করেন। চলতি ২০২৫ সালের জন্য অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন অর্থনীতিবিদ-জোয়েল মোকির, ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট। উদ্ভাবননির্ভর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁরা এ পুরস্কার পেয়েছেন। পরিশেষে বলব, ২০২৫ সালের চিকিৎসা, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো মানবজীবনের গুণগত পরিবর্তনের বিষয়ে নতুন আশা ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |