স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ওয়্যারলেসে প্রথম প্রচার করেছিল ইপিআর
আলমগীর হোসেন
|
রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন থেকে আজকের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বিভিন্ন সময়ে নানা নামে নামকরণ করা হয়। ১৯৭১ সালে বিজিবি ছিল ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) নামে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসে ইপিআর এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ করার পাশাপাশি স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলমন্ত্র বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি প্রথম ইপিআরের নিজস্ব ওয়্যারলেসযোগেই সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচারের সেই দুঃসাহসিক কাজটি করেছিলেন তৎকালীন ইপিআরের সুবেদার মেজর (সিগন্যাল) শওকত আলী। এর জন্য তাকে হানাদার বাহিনী আটক করে দীর্ঘদিন অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। এ ছাড়াও সাত বীরশ্রেষ্ঠ শহীদের অন্যতম একজন নূর মোহাম্মদ শেখ ছিলেন ইপিআরের ল্যান্স নায়েক। যার বীরত্বগাথা প্রায় সবারই জানা। এদিকে পাকিস্তান বাহিনী ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে অপারেশন সার্চলাইট নামে ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা, বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটি তাদের পূর্বপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। তারা তাদের পরিকল্পনা মতো সম্ভাব্য যেসব বাহিনীর দিক থেকে প্রতিরোধ শুরু হতে পারে, সেটি বিবেচনায় নিয়েই ইপিআর হেডকোয়ার্টার আক্রমণ শুরু করে। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে পাকিস্তান বাহিনী ঢাকা সেনানিবাস থেকে ট্যাঙ্ক, বন্দুক, সাঁজোয়া বাহিনীসহ সব সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বের হয়ে পরিকল্পনা মতোই এগিয়ে যায়। পিলখানা ইপিআর-প্রধান দফতরে তখন অবস্থানরত প্রায় আড়াই হাজার সদস্যকে আক্রমণ করতেই ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টকে পাঠানো হয়। এরা দফতরে ছয়টি ফটক দিয়ে ঢুকে গোটা পিলখানা ইপিআর-প্রধান দফতর ঘিরে ফেলে। রাত ১২টায় তারা প্রথম গুলি ছোড়ে। অতর্কিতে তাদের হামলায় বাঙালি সদস্যদের মধ্যে সাময়িকভাবে কিছুটা আতঙ্ক ছড়ালেও একের পর এক তাদের সব আক্রমণ প্রতিরোধ করতে শুরু করে বাঙালি সদস্যরা। তবে অধিকাংশ বাঙালি সদস্যের হাতে অল্পসংখ্যক অস্ত্র থাকায় বেলুচদের আক্রমণ দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না। এখানে বেশ কয়েকজন বাঙালি ইপিআর সদস্য ওই রাতে শহীদ হন। তবে অনেকেই দেওয়াল টপকে কেরানীগঞ্জের দিকে চলে যান, তারা সেখান থেকে পরদিন প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। তবে অনেকেই পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি হয়ে যান, যাদের কেউ কেউ নির্যাতনে প্রাণ হারান। এ ছাড়া সেই রাতে গভর্নর হাউস, ডিআইটি ভবন, মিরপুর, গুলশান, রমনার ডাকঘর, কমিশনার ভবন পাহারাতে ইপিআরের বাঙালি সদস্যদের অনেকেই দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ছিলেন। বিশেষত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ডিআইটি ভবনের ওপর থেকে গভর্নর হাউসের দিকে গুলিবর্ষণ করে। বাঙালি গার্ড সদস্যদের বন্দি করে নিয়ে যায়। প্রায় একশ বাঙালি ইপিআর সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়। এদের সবাইকে রমনা কালীবাড়ির সন্নিকটে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পিলখানা সদর দফতর থেকে ২৫ মার্চ রাতে বের হয়ে আসা ইপিআর সদস্যরাই প্রথমে জিঞ্জিরায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি বাহিনী বড় ধরনের অস্ত্র, গোলা-বারুদ এবং সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করলে ইপিআর বাঙালি সদস্যরা দোহার, নবাবগঞ্জ ও শ্রীনগরে প্রতিরোধ শুরু করেন। ক্রমেই ইপিআর সদস্যরা পুলিশ-আনসারসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধে নেমে পড়েন। দেশের ভেতরেও তারা ছড়িয়ে পড়েন। ভারতে গিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার খবর জানাজানি হলে ইপিআরের অনেকেই সীমান্ত ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, পাটগ্রাম, গনিরহাট, হরিণমারী, তালপুকুর, টাঙ্গন ব্রিজ, বকশীগঞ্জ, হাতিবান্ধা, সেক্টর হেড কোয়ার্টার্স সিলেট, বরিশাল, পাবনা, নোয়াখালীতে ইপিআরের সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিরোধ সংঘটিত করেন। |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |