শিক্ষা দিবসের চেতনা ও বর্তমান বাস্তবতা
শ্যামল শর্মা
প্রকাশ: বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১১:০৭ এএম আপডেট: ১৬.০৯.২০২০ ১১:৩৭ এএম

সকলেই জানি ‘যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত’।  শিক্ষা ছাড়া উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণ কল্পনামাত্র।  তাই একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে দূর্বল করে দিলেই হয়।  পূর্বে দেখা গেছে অনেক বড় বড় যুদ্ধে বিজয়ী শক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরি ধ্বংস করে দিয়েছে যেন সে জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যত প্রজন্ম অবগত না হতে পারে।
শিক্ষা দিবসের চেতনা ও বর্তমান বাস্তবতা

শিক্ষা দিবসের চেতনা ও বর্তমান বাস্তবতা

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হবার পর পাকিস্থান দুই অংশে বিভক্ত হলো।  পশ্চিম পাকিস্থান আর পূর্ব পাকিস্থান। এতে পূর্ব পাকিস্থানি মানুষের ভাগ্যাকাশে বজ্রপাত ঘটলো।  নেমে এলো ঘোর অমানিশা।  শুরু হল ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা। অতঃপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালির মনে প্রথম স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়। তারপর থেকেই বাঙালির মনে একটু একটু করে স্বাধীন হবার বারুদ জন্ম নেওয়া শুরু করে। ঠিক এমন সময় ১৯৬২ সালে স্বৈরাচার আইয়্যুব সরকার তৎকালীন শিক্ষা সচিব এস. এম. শরীফের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন  গঠন করে প্রনয়ন করলেন চরম বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি, যা শরিফ কমিশন নামে পরিচিত।  যার মাধ্যমে স্বৈরাচার আইয়্যুব শাহী মনের অজান্তে সেই বারুদে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়েছিল। 

“সস্তায় শিক্ষা লাভ করা যায় না।  যেমন দাম তেমন জিনিস।  অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা কল্পনা মাত্র। প্রাথমিক বিদ্যালয়ই হবে আমাদের বেশীর ভাগ ছেলে-মেয়ের শিক্ষা জীবনের শেষ স্তর। শিক্ষাব্যবস্থা হবে সাম্প্রদায়িক, পরিচালিত হবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে, যাদের টাকা আছে তারাই পড়তে পারবে, সবাই শিক্ষার অধিকার পাবে না, উচ্চশিক্ষার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত হবে না, যারা নিশ্চিতভাবে ঝরে পড়বে তাদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। শিক্ষা উপকরণ ও সরঞ্জাম নিজেদের কিনতে হবে এমনকি বিদ্যালয়টাও নিজেদের তৈরি করে নিতে হবে।  প্রয়োজনে অতিরিক্তি অর্থ খরচ করার মানসিকতা থাকতে হবে।  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন থাকবে না।  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণীর আলেম সৃষ্টির জন্য কাজ করতে হবে”।  এসব ছিল শরিফ কমিশনের মূলমন্ত্র।  মূলত এতে স্বৈরাচারী আইয়্যুব শাহীর ধর্মান্ধতা, পুঁজিবাদী, রক্ষনশীলতা, সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা সংকোচন নীতির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল।

শিক্ষা দিবসের পটভূমি: 

সময়টি ১৯৬২ সালের  ১৭ সেপ্টেম্বর।  ‘টাকা যার শিক্ষা তার’ এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে শিক্ষাকে পণ্যে পরিনত করে শিক্ষাকে একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতে তুলে দেবার প্রস্তাবসহ একটি সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি এদেশের জনগনের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চাইলেন তৎকালীন আইয়্যুব সরকার।  এই চরম বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সদাজাগ্রত ছাত্রসমাজ সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ হরতাল আহ্বান করে এবং এর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে পেশাজীবী, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ।  ইতোমধ্যে বাঙালির আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করে দিয়েছিল।  তারা বুঝতে পেরেছিল এটি শুধু ছাত্রদের শিক্ষা সম্পর্কিত আন্দোলন নয়, বরং এটি স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের মহেন্দ্রক্ষণ। 

১৭ সেপ্টেম্বর সকাল নয়টায় বের হয় ছাত্র জনতার বিরাট মিছিল।  মিছিলটি যখন হাইকোর্ট পার হয়ে আব্দুল গণি রোডে প্রবেশ করে তখনই অতর্কিতভাবে পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে ।  রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে বাবুল, গোলাম মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহসহ নাম না জানা অনেক ছাত্র ।  পিচ ঢালা রাজপথ রক্তে সিক্ত হলো।  রাজপথকে নরকপূরিতে পরিনত করে পিছু হটলেন স্বৈরাচার আইয়্যুব শাহী সরকার।  পারলেন না তার বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে।  পরবর্তীতে একটি গনমূখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়।  আর ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতি বিজড়িত দিনটি প্রতিষ্ঠা পায় ‘জাতীয় শিক্ষা দিবস’ হিসেবে।
বর্তমান বাস্তবতা: 

দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করে আমরা পেয়েছি একটি মানচিত্র, স্বাধীন ভূখন্ড, একটিা লাল সবুজের পতাকা।  পেয়েছি একটি শিক্ষা দিবস।  কিন্তু দুঃখের বিষয় এই দিবসটি এখন বাম প্রগতিশীলরা ছাড়া কেউ মনে রাখে না।  এমনকি এদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে যে দিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সেই দিনটি  রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করাও হয় না।  শিক্ষা ও ছাত্র আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ এই ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।  ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই অজানা ইতিহাসের এ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের কথা।  তারা বঞ্চিত এর তাৎপর্য অনুধাবন থেকে।  প্রকৃতপক্ষে  শিক্ষা দিবসের ৫৮ বছর পরেও ছাত্রসমাজের সার্বজনীন শিক্ষার যে আকাক্সক্ষা তা আজও পূর্ণ হয়নি।  কিছুটা সংশোধন হলেও সেই ব্রিটিশ-পাকিস্থানি আমলে কেরানি কর্তৃক নির্মিত শিক্ষাব্যবস্থা এখনো বহাল আছে।  শিক্ষা এখনো বাজারে উঠে। তবে  পার্থক্য একটিই।  আগে বিক্রি হতো খোলা বাজারে আর এখন বিক্রি হয় শো-রুমে। হু-হু করে বাড়ছে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুল-কলেজ, যেখানে পড়তে প্রয়োজন প্রচুর অর্থ।  যেখানে দেশের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে পড়ানো অসম্ভব।

অবশেষে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে গিয়ে আমরা পেয়েছি জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১১ যেখানে চমৎকার প্রাঞ্জল ভাষায় কৌশলে দেওয়া হয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি।  শিক্ষা দিবসের চেতনায় উঠে আসা সর্বজনীন, বৈষম্যহীন, একই ধারার বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষাকে করা হয়েছে বেসরকারিকরণ ও বানিজ্যিকীকরণ।  এ যেন নতুন বোতলে সেই পুরানো মদ! যার প্রভাবে সারাদেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা সর্বস্তরেই চরম নৈরাজ্য চোখে পড়ছে।

দেশে এখনো  প্রাথমিক স্কুলের ঘাটতি রয়েছে।  রয়েছে শিক্ষক সঙ্কট।  এখনো জাতীয়করণের দাবিতে এমপিও ভুক্ত বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক/কর্মচারিদের  আমৃত্যু অনশনে যেতে হয়।  যা শিক্ষা দিবসের চেতনার পরিপন্থী।  আমাদের স্মরণে রাখা উচিৎ সেদিন বাবুল, গোলাম মোস্তফাদের রক্তে রাজপথে শুকিয়ে যায়নি, সঞ্চালিত হয়েছিল জাতির ধমনিতে, মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরায়।  আর ঐ রক্তের স্রোত গিয়ে মিশেছিল আর এক রক্তগঙ্গায়।  অবশেষে গিয়ে মিলিত হয় স্বাধীনতার মোহনায়। 

তাই দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সার্বজনীন মতামতের ভিত্তিতে একটি শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করা, যেখানে শিক্ষা হবে সবার জন্য অবাধ।  ‘শিক্ষা কোন পণ্য নয়, শিক্ষা সকলের অধিকার’ এটি সর্বস্তরে প্রতিফলিত হোক মহান শিক্ষা দিবসে এটিই প্রত্যাশা।

৫৮ তম মহান শিক্ষা দিবসে প্রত্যাশা: 

তাৎপর্যপূর্ণ মহান শিক্ষা দিবসের ইতিহাস মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।  রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিনটি পালনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।  শিক্ষা দিবসের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে গ্রাম ও শহরের মাঝে শিক্ষা বৈষম্য দূর করতে হবে।  বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনতে হবে।  হাওড়, বাওড়, পাহাড় ও দুর্গম অঞ্চলকে কমিউনিটি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের আওতায় আনার কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের সন্ধ্যকালীন কোর্স বাতিল করে দ্বিতীয় শিফট চালু এবং সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।  তবেই ৬২’র মহান শিক্ষা দিবসের সকল শহীদের আত্মত্যাগের উদ্দেশ্য সফল হবে।


                                                                                                                                                                                                                            লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, যশোর জেলা শাখা।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com