রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবতা বনাম বহুলাংশ প্রতারণা
রাফায়েল আহমেদ শামীম
প্রকাশ: শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫, ৩:৫৪ পিএম

রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবতা বনাম বহুলাংশ প্রতারণা

রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবতা বনাম বহুলাংশ প্রতারণা

রাজনীতি ও প্রতিশ্রুতি এই দুটি উপাদান মানব সমাজের রাজনৈতিক বুননে অঙ্গীভূত। রাষ্ট্র পরিচালনার জটিল কাঠামোর মধ্যে, রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি প্রদান একটি অপরিহার্য রাজনৈতিক কৌশল। বিশ্বজুড়ে প্রতিশ্রুতির অবকাঠামো প্রায় অভিন্ন। নির্বাচনের পূর্বাভাসে নেতারা অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য, কখনও কখনও হাস্যকর প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। এই আচরণের একটি যথার্থ উদাহরণ হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রখ্যাত নেতা নিকিতা ক্রুশচেভের উক্তি : Politicians are the same all over. They promise to build bridges even where there are no rivers. এ উক্তিটি কেবল রাজনৈতিক রসিকতা নয়, বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে রাজনৈতিক আচরণের প্রতিফলন।

নদীর অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া মানে রাজনৈতিক আশ্বাসের সঙ্গে বাস্তবতার দ্বন্দ্ব। উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে, এই ধারা আরও প্রকট। নির্বাচনের পূর্বে হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব ক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা বাস্তবে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতার পরিসীমার বাইরে। এই প্রতিশ্রুতি জনগণের মন জয় করার রাজনৈতিক কৌশল, কিন্তু বাস্তবায়ন ক্ষমতার অভাবে তা প্রায়শই ব্যর্থ হয়। উন্নত দেশের প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি সবসময় বাস্তবসম্মত। সেখানে নাগরিক সচেতন, গণমাধ্যম সক্রিয় এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলে নেতারা জবাবদিহির মুখোমুখি হন এবং প্রায়শই পদও হারান। এই পার্থক্যই দেখায় যে, প্রতিশ্রুতির নৈতিক এবং বাস্তবমুখী প্রভাব দেশের প্রশাসনিক ও নাগরিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল।

উন্নয়নশীল দেশে অনেক অভিজ্ঞ ও নৈতিক রাজনীতিবিদ আছেন, যারা প্রতিশ্রুতি প্রদানের আগে অগ্র-পশ্চাৎ কৌশল, আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা এবং সম্ভাব্য প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা মূল্যায়ন করেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা যতটা সম্ভব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার চেষ্টা করেন। পাঁচ বছরের মেয়াদে, সুশাসন এবং বাস্তবমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সম্ভব। অপ্রয়োজনীয় বা লোক-দেখানো প্রতিশ্রুতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়; এটি দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় উন্নয়নকে বিপর্যস্ত করে। বাংলায় প্রচলিত আছে ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’, যা নির্দেশ করে সীমিত আর্থিক সম্পদ ব্যয় করার ক্ষেত্রে অসচেতনতার ফলাফল। তাই রাজনীতিবিদদের জন্য অপরিহার্য বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতি, যা দেশের সামর্থ্য এবং জনগণের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

প্রতিটি নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির একটি বাস্তব অর্থনৈতিক মূল্য থাকে। অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দেওয়া কেবল দায়িত্বহীনতা নয়, বরং এটি জনগণের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। নাগরিকদের উচিত এই বাস্তবতা উপলব্ধি করা এবং রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন যাচাই করা। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সময়কালও গুরুত্বপূর্ণ। তারা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য দায়িত্বে আসেন, তাই কার্যক্রম সময়মতো সম্পন্ন করার জন্য পরিকল্পনা অপরিহার্য। বাহবা কুড়ানোর জন্য বা নির্বাচনি চশমার আড়ালে লোক- দেখানো প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করা দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি। নাগরিকদেরও এই ফাঁদ থেকে সচেতন থাকা প্রয়োজন। সচেতন নাগরিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা যাচাই করতে পারে, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে এবং রাজনীতিবিদদের দায়বদ্ধ করতে পারে। নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতির যাচাই, বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতিকে ভোটের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ এবং সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এসবই দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

নাগরিক সচেতনতা ছাড়া রাজনীতিবিদদের দায়বদ্ধতা অর্ধেকই থাকে। রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি কেবল নির্বাচনি হাতিয়ার নয়; এগুলো দেশের অর্থনীতি, জনগণের জীবনমান এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অবাস্তব প্রতিশ্রুতি বা লোক-দেখানো প্রকল্পে অর্থ ব্যয় কেবল দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করে। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে পরিকল্পিত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেওয়া, সরকারি অর্থব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা, অপচয় ও দুর্নীতি দূর করে জনকল্যাণ নিশ্চিত করা এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজের ওপর বিনিয়োগ করা অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, দেশের কিছু অঞ্চলে নির্বাচনের আগে বিদ্যুৎ, পানি বা সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি নির্বাচনের পরে কার্যকর হয়নি। মূল কারণ ছিল পরিকল্পনার অভাব, অর্থের সীমাবদ্ধতা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা। অন্যদিকে, নাগরিক সচেতনতা ও গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ সক্রিয় থাকা ক্ষেত্রে নেতারা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য বাধ্য হন। এটাই দেখায় নাগরিক অংশগ্রহণের গুরুত্ব।
রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব হলো বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং তা রক্ষা করা। নাগরিকদের দায়িত্ব হলো প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা যাচাই করা, সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ রাখা এবং সচেতন ভোটদাতা হয়ে দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এই দ্বৈত দায়িত্ব ছাড়া দেশের টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। অবস্থান অনুযায়ী, রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি দেশের অর্থনীতি, জনগণের জীবনমান এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। নাগরিক সচেতনতা, বিচারবুদ্ধি এবং সামাজিক নজরদারি ছাড়া এই প্রতিশ্রুতিগুলো দেশের উন্নয়নে রূপান্তরিত হতে পারে না। তাই অবাস্তব প্রতিশ্রুতি থেকে বেরিয়ে আসা, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার ওপর নজর দেওয়া এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনা করা অপরিহার্য। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক ও নাগরিক দ্বৈত দায়িত্বের ভারসাম্য অপরিহার্য। শুধু মাত্র প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ভিত্তিতে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রতিশ্রুতির অর্থনৈতিক মূল্য বিবেচনা, বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা, সরকারের স্বচ্ছতা এবং নাগরিক সচেতনতা এসবই দেশের স্থিতিশীল ও টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি।

উপসংহারে, রাজনীতিবিদরা প্রতিশ্রুতি দেন কিছু বাস্তবসম্মত, কিছু অবাস্তব। জনগণের সচেতনতা, বিচারবুদ্ধি এবং সামাজিক নজরদারি ছাড়া প্রতিশ্রুতিগুলো দেশের উন্নয়নে রূপান্তরিত হতে পারে না। তাই রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব এবং নাগরিক সমাজের দ্বৈত দায়িত্বে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। অবাস্তব প্রতিশ্রুতি থেকে বেরিয়ে আসা, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার ওপর নজর দেওয়া এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনা করা এসবই দেশের দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি। 


লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা।



ডেল্টা টাইমস্/রাফায়েল আহমেদ শামীম/আইইউ

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com