সালেহ হত্যা সাংবাদিক নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক দায়
রাফায়েল আহমেদ শামীম:
|
![]() সালেহ হত্যা সাংবাদিক নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক দায় সাংবাদিক হত্যার রাজনৈতিক অর্থ গভীর এবং সুপরিকল্পিত। এটি নিছক ব্যক্তি হত্যা নয়; বরং এটি তথ্য দমন এবং ইতিহাসকে নিজের স্বার্থে বিকৃত করার প্রক্রিয়ার অংশ। সংঘাতকেন্দ্রে সাংবাদিকরা হলেন প্রমাণ ধারণকারী, যাদের ক্যামেরা ও কলম যুদ্ধের বাস্তব চিত্র নথিভুক্ত করে। সালেহ আলজাফারাওয়ি যুদ্ধক্ষেত্রের ভিডিও ও ছবি দ্বারা বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন যে, গণহত্যা এবং বেসামরিকদের ওপর হত্যাযজ্ঞ কতটা ভয়াবহ। এই সাক্ষ্য যদি ধ্বংস করা হয় বা সাংবাদিককে হত্যা করা হয়, তবে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ভিত্তি দুর্বল হয়। সত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে এই ধরনের হুমকি শুধুমাত্র গাজার নয়, সমগ্র মানবাধিকারের জন্য হুমকি। সালেহ আলজাফারাওয়ির হত্যার পর গাজার সাংবাদিকদের মনে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করার বিষয়। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় একটি স্পষ্ট বার্তা ছড়িয়েছে যে, বাহ্যিক সেনা সরে গেলেও স্থানীয় মিলিশিয়াগুলো সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক কৌশল, যা সাংবাদিকদেরকে সত্য প্রকাশ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তি তার কর্মকাণ্ডকে আড়াল করতে সক্ষম হয়। সালেহের মতো সাংবাদিকরা যখন নিজ জীবন বাজি রেখে তথ্য সংগ্রহ করেন, তখন সেই তথ্যের মাধ্যমে সত্যকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। আন্তর্জাতিক আইনের ব্যর্থতা এই হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে পারছে না। সাংবাদিক হত্যাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও বাস্তবে অভিযুক্তদের শাস্তি পাওয়া বিরল। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উচিত সাংবাদিকদের হত্যাকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীন, স্বচ্ছ ও নিবিড় তদন্ত পরিচালনা করা। তদন্ত ব্যর্থ হলে অপরাধীরা দায়মুক্ত থাকে এবং সাংবাদিকদের ওপর হুমকি ক্রমবর্ধমান হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক ও কূটনৈতিক কর্তব্য হলো নিশ্চিত করা যে, সাংবাদিকদের জীবন নিরাপদ এবং হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জ। সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি মূল্যায়ন, প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা সরঞ্জাম এবং জরুরি তহবিল থাকা অপরিহার্য। বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্র, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সামরিক দমনপ্রক্রিয়ায় সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা রক্ষা করা আবশ্যক। আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ইউনিয়ন, মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগে একটি কার্যকর নিরাপত্তা কাঠামো থাকা উচিত, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিকরা দ্রুত সহায়তা পেতে পারেন। প্রশিক্ষণে ঝুঁকি নির্ণয়, প্রাথমিক চিকিৎসা, নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল তথ্য সুরক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ডিজিটাল যুগে সাংবাদিকদের হুমকি ক্রমবর্ধমান। সালেহ আলজাফারাওয়ির অ্যাকাউন্ট একাধিকবার স্থগিত হয়েছিল, যা প্রমাণ করে যে অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও সাংবাদিকদের কণ্ঠ নিরপেক্ষভাবে সুরক্ষিত নয়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিমালার আওতায় আনা জরুরি, যাতে তারা সেন্সরশিপের মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রতিবেদন বন্ধ করতে না পারে। সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার জন্য এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন, বহুমাত্রিক ব্যাকআপ এবং অনলাইন ট্র্যাকিং প্রতিরোধক সরঞ্জাম প্রদান আবশ্যক। স্থানীয় ক্ষমতা শূন্যতা সাংবাদিকদের বিপদ আরও বাড়ায়। যখন বাহিনী সরে যায়, তখন স্থানীয় মিলিশিয়াগুলো প্রায়শই রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবাদিকদের হুমকির মুখে ফেলে। সালেহ আলজাফারাওয়ির হত্যা এভাবেই সংঘটিত হয়েছেÑএকটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, যা তথ্যপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, যাতে সাংবাদিকদের ওপর হুমকি, নির্যাতন এবং হত্যা বন্ধ হয়। আইনি কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ছাড়া সাংবাদিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন, স্বচ্ছ ও নিবিড় অনুসন্ধান বাধ্যতামূলক করতে হবে। অভিযুক্তদের শনাক্তকরণ, প্রমাণ সংগ্রহ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের উপস্থাপন করা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক আদালত, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের ভিত্তিতে অনুসন্ধান ছড়িয়ে দিলে অভিযুক্তদের অপরাধমুক্ত রাখা কঠিন হয় এবং প্রতিকারপ্রাপ্তি সহজ হয়। সাংবাদিকদের মানসিক ও আর্থিক সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ। সংঘাতপরবর্তী সময়ে পরিবারগুলোর জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সাংবাদিকদের জন্য পেশাগত নিরাপত্তা শুধুমাত্র একটি ধারণা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে আইনি সহায়তা, আর্থিক অনুদান এবং কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে সাংবাদিকতার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য স্থায়ী কাঠামো অপরিহার্য। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভূমিকা গুরুত্বপুর্ণ। সাংবাদিকতা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত শিক্ষার্থীদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করা, যাতে তারা নৈতিক, তথ্যভিত্তিক ও নিরাপদ সাংবাদিকতা করতে সক্ষম হয়। সংবাদ সংস্থাগুলোর ভিতরও নিরাপত্তা নীতিমালা, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং সহায়ক কাঠামো স্থাপন করলে কর্মীরা ঝুঁকির মুখে সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আন্তর্জাতিক সংহতির ভূমিকাও অপরিহার্য। সাংবাদিক হত্যার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য জনমতের শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে। তথ্যভিত্তিক ইভ্যালুয়েশন, প্রতিবেদনের পুনরাবৃত্তি এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কেস তুলে ধরা এই প্রচেষ্টা শক্তিশালী করে। সংস্থা, ফিলানথ্রপি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম মিলিতভাবে সাংবাদিক নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারে। আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠনগুলো ধারাবাহিকভাবে এই কেসগুলো প্রকাশ করলে অপরাধী বুঝতে পারে যে তার কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক নজরদারির আওতায় রয়েছে এবং প্রতিকারপ্রাপ্তি সহজ। অবশেষে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু প্রতিশ্রুতির বিষয় নয়, এটি বাস্তব পদক্ষেপ, সংস্থান বরাদ্দ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সম্ভব। সালেহ আলজাফারাওয়ির হত্যাকাণ্ড আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে তথ্যের নিরাপত্তা একটি গ্লোবাল পাবলিক গুড। সাংবাদিকদের জীবন এবং কাজের মূল্য রক্ষা করতে হবে, যাতে আর কোনো কণ্ঠকে সহজে দমিয়ে ফেলা না যায়। নিরপেক্ষ তদন্ত, প্রশিক্ষণ ও তহবিল, প্ল্যাটফর্ম দায়বদ্ধতা, কূটনৈতিক চাপ ও আইনি ব্যবস্থাÑএই সব উপাদান সংহত করে সাংবাদিক নিরাপত্তা বাস্তবে অর্জিত হবে। একমাত্র ঐক্যবদ্ধ ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব যে সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকির সঙ্গে সমানভাবে মূল্যবান একটি পেশা হিসেবে কাজ করতে পারবে। বাংলাদেশ ও বিশ্বের সাংবাদিকরা এখনও নিরাপত্তাহীন। তথ্যের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। সালেহ আলজাফারাওয়ির রক্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে সত্যের বিজয় সম্ভব নয়। তাই শুধুমাত্র নিন্দা বা সমবেদনা নয়, প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে সাংবাদিকরা নিরাপদে, স্বাধীনভাবে এবং সাহসের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা। ডেল্টা টাইমস/রাফায়েল আহমেদ শামীম/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |