আগুনের আলোয় দেখা যায় না মানবতা
সাদিয়া জাহান সুরভী
|
![]() আগুনের আলোয় দেখা যায় না মানবতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আগুনের সূত্রপাত ঘটে গা, ফ্যাক্টরিতে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ শক্তি হলো গারমেন্টস শিল্প। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এখানে কর্মরত। রপ্তানির ৮০% আসে এই খাত থেকে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ড কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই সাফল্যের ভেতরে লুকিয়ে আছে জীবনের ঝুঁকি ও অবহেলার গল্প। যখন শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না তখন উন্নয়নের কথা মুখে বলা হলেও সেটি হয় মানবিক শূন্যতার উন্নয়ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আগুন লাগে ভবনের রাসায়নিক গুদাম থেকে, বৈদ্যুতিক শর্ট- সার্কিট থেকে। তদন্তে উঠে আসে একই কারণ— ভবনে অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থ, দরজা বন্ধ রাখা, অকেজো অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণের অভাব এবং সর্বোপরি শ্রমিক নিরাপত্তার প্রতি চরম অবহেলা। এই অবহেলার মূল কারণ লুকিয়ে আছে মানসিকতা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর গভীরে। শ্রমিকদের ‘মানুষ’ হিসেবে নয়, ‘যন্ত্র’ হিসেবে দেখা হয়। পুঁজিবাদের ফাঁদে পড়ে মানুষ আজ মানবিক সত্তা হারিয়ে বস্তুতে পরিণত হয়েছে। অচেতন, অনাবেগী, অমানবিকরণ কাঠামো মানুষকে ধীরে ধীরে তুচ্ছ করে ফেলছে— যেন পোকার মতো মূল্যহীন। অন্যদিকে, অনেক মালিকের কাছে ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ মানে বাড়তি খরচ। দরজা খোলা রাখলে নিরাপত্তা প্রহরী বাড়াতে হবে— তাই তারা দরজা বন্ধ রাখে। সামান্য খরচ বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ চলে যায়, অথচ কারো বিবেক নড়ে না। প্রশাসনের দুর্বলতা ও দায়হীনতাও সমানভাবে দায়ী। শ্রম পরিদর্শন বিভাগ অনেক সময় নিয়মিত পরিদর্শন করে না; আবার সমাজে এখনো শ্রমিক মানেই ‘নিচু শ্রেণি’— এই মানসিক বিভাজন থেকেই সহানুভূতির অভাব জন্ম নেয়। ফলে শ্রমিকের মৃত্যু বা দুর্ঘটনাও “স্বাভাবিক” মনে হয়— এটাই আমাদের সবচেয়ে ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়। একজন শ্রমিকের ঘামে বোনা হয় আমাদের শিল্পের প্রাণ। তাই এই আগুন শুধু মানুষ বা ভবন নয়, আমাদের বিবেককেও দগ্ধ করে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়— কেন বারবার একই রকম অগ্নিকাণ্ড ঘটে? এটি কি নিছক কাকতালীয় ঘটনা, নাকি কোনো সংগঠিত স্বার্থ চক্রের কাজ? নাকি আমাদের পুরোনো ভবন, জীর্ণ বৈদ্যুতিক তার, আর অবহেলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফল? আজ সময় এসেছে আগুনের বিরুদ্ধে শুধু পানি নয়, নীতির আগুন জ্বালানোর। শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা মানেই একটি জাতির সম্মান রক্ষা। রাষ্ট্র, মালিক ও সমাজ— সবাইকে মিলিতভাবে মানবিক দায়িত্বের চেতনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি শ্রমিক যেন কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারে নিশ্চিন্ত মনে, প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে যেন আগুন নয়, জ্বলুক জীবনের আলো। এখন সময় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার। শিল্প ও গারওমন্টসে বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ, কার্যকর ফায়ার অ্যালার্ম ও এক্সটিংগুইশার, দরজা খোলা রাখা ও জরুরি নির্গমন পথ নিশ্চিত করা, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছাড়া ভবন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা, জনসচেতনতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা— এসব এখন অতীব জরুরি। সেইসাথে আগুন প্রতিরোধে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। আগুনের শিখা নিভবে তখনই, যখন আমরা আগে থেকেই প্রস্তুত থাকব। মানবতার আলো জ্বলবে, যদি আমরা আগুনের আগে জ্বালিয়ে তুলি আমাদের বিবেক। কারণ, আগুনের আলোয় দেখা যায় না মানবতা— কিন্তু মানবতার আলোয় নিভে যেতে পারে আগুনের নিষ্ঠুর শিখা। যে সমাজ শ্রমিকের অশ্রু ও আহাজারি শুনতে পায় না, সে সমাজ কখনো টেকসই হতে পারে না। এখন দরকার নতুন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে শ্রমিক হবে রাষ্ট্রের হৃদয়, না যে প্রান্তিক। প্রতিটি কারখানায় নিরাপত্তা হবে মৌলিক অধিকার, সহমর্মিতা হবে নীতি। আসুন, আমরা সবাই একসাথে এমন এক সমাজ গড়ি, যেখানে আগুন নয়— জ্বলবে কেবল মানবতার উষ্ণ আলো। লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। ডেল্টা টাইমস্/সাদিয়া জাহান সুরভী/আইইউ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |