ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে আজকের হাতে
রহমান মৃধা:
|
![]() ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে আজকের হাতে বাবা-মা ভাবে, সন্তান যেন “ভালো ভবিষ্যৎ” পায়; শিক্ষক শেখায় পরীক্ষায় ভালো করতে, যেন ভবিষ্যতে সফল হয়; সমাজ বলে, নিরাপদ পেশা নাও—ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে। এভাবেই জীবনের প্রতিটি ধাপ পরিকল্পিত হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের নামে, অথচ বর্তমান থাকে উপেক্ষিত, নিঃশব্দ ও অপূর্ণ। এই কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র প্লাবন—এক সাধারণ তরুণ, যে আধুনিক সমাজের ভবিষ্যৎ-নেশার প্রতীক। জন্মের সময়ই বাবা বলেছিলেন, “ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবো।” স্কুলে শিক্ষক বলেছিলেন, “তুমি যদি এই পরীক্ষায় ভালো না করো, তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।” অথচ প্লাবন ছোটবেলায় ভালোবাসত আকাশ দেখতে। কিন্তু সবাই বলত, “এইসব দেখার সময় নেই, বই খোলো, ভবিষ্যৎ গড়ো।” বছর কেটে গেল। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়—সব স্তরে সে ছুটল “ভবিষ্যৎ গড়ার” দৌড়ে। কিন্তু প্রতিটি সফলতার পরও তার ভেতরে জমতে থাকল এক অদৃশ্য শূন্যতা। কারণ সে যা করছে, তা আজকের আনন্দ বা তৃপ্তির জন্য নয়—সবই “আগামী কাল”-এর নামে। প্রতিটি সকাল শুরু হয় ভবিষ্যতের চিন্তায়, প্রতিটি রাত ঘুমিয়ে পড়ে অনিশ্চয়তার ভয়ে। একদিন প্লাবন নিজেকে প্রশ্ন করল— “যে ভবিষ্যতের জন্য আমি বেঁচে আছি, সেটি কখন আসবে? আমি তো সবসময় তার অপেক্ষায় থেকেছি, অথচ আজও সেটি ‘আগামী কাল’। তাহলে কি আমি আসলে কখনও বাঁচিনি?” এটাই “ভবিষ্যতের প্লাবন”—যেখানে মানুষ নিজের আজকে ডুবিয়ে ফেলে আগামী কালের স্বপ্নে। এই প্লাবন শুধু এক ব্যক্তির নয়, এক প্রজন্মের বাস্তবতা। আমরা এমন এক সময়চক্রে বন্দি, যেখানে জীবনের মূল্য নির্ধারিত হয় ভবিষ্যতের সম্ভাবনায়, বর্তমানের অভিজ্ঞতায় নয়। মানুষ চিরকাল “আগামী কাল” নামের এক অলৌকিক প্রতিশ্রুতির পেছনে ছুটে বেড়ায়। আজকের ক্লান্তি, অনিশ্চয়তা বা ভয় থেকে বাঁচতে আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিই—“আগামী কাল সব ঠিক হবে।” কিন্তু সত্যি বলতে, সেই আগামী কাল কখনও আসে না। প্রতিটি আগামী কাল এসে আজ হয়ে যায়, আর আমরা আবারও নতুন এক আগামী কালের অপেক্ষায় থাকি। সময়ের এই নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ যেন আমাদের শেখায়—ভবিষ্যৎ কোনো আলাদা সময় নয়; এটি আজকেরই পরিণতি, আজকেরই রূপান্তর। জীবনের আসল অলৌকিকতা এখানেই যে, সময়কে ধরা যায় কেবল আজকের মধ্যে। যে আজকে বাঁচতে জানে, সে-ই ভবিষ্যৎকে গড়তে জানে। একজন কৃষক আজ বীজ বোনে, এই বিশ্বাসে যে কাল ফসল হবে—কিন্তু ফসল জন্মায় না কোনো অলৌকিক আগামী কাল থেকে; বরং আজকের শ্রম, ঘাম ও যত্ন থেকেই। একজন লেখক আজ চিন্তা করে, লেখে, প্রশ্ন তোলে—তার আজকের কলমেই জ্বলে ওঠে আগামী দিনের সমাজ। একজন প্রেমিক আজ ভালোবাসে, ক্ষমা করে, ফিরে আসে—তার আজকের ভালোবাসাই পরিণত হয় স্থায়ী সম্পর্কের দৃঢ়তায়। তবুও মানুষ আজকে অবহেলা করে। আমরা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করি, ভবিষ্যতের জন্য ভয় পাই, ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করি; অথচ সেই ভবিষ্যৎ গঠনের উপাদান—“আজ”—আমরাই নষ্ট করে ফেলি। এ এক অদ্ভুত ট্র্যাজেডি—যে দিনটি আমরা বাঁচতে পারতাম, তা পরিকল্পনা ও আশঙ্কার ভারে চাপা পড়ে যায়। জীবনের আসল আনন্দ, সৃজনশীলতা ও দায়িত্ব সবই গড়ে ওঠে এই বর্তমান মুহূর্তের বুকে। দার্শনিক হাইডেগার বলেছিলেন, মানুষ “অস্তিত্বের অপেক্ষায় থাকা প্রাণী”—সে চিরকাল কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু জীবন কোনো অপেক্ষা নয়; জীবন নিজেই এক অবিরাম “এখন”-এর ধারা। রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন, “কাল যদি আসে, আজকের হাতে তারই বীজ।” এই বীজই আমাদের বাঁচার দায়—আজ যদি মাটি না ছোঁও, তবে আগামী কাল কেবলই শূন্য মাঠ। আজ আমরা যদি ন্যায় হারাই, আগামী কাল ন্যায়বিচার পাব না। আজ যদি ভালোবাসতে না পারি, আগামী কাল সম্পর্ক টিকবে না। আজ যদি দায়িত্ব ভুলে যাই, আগামী কাল ভেঙে পড়বে প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র—সবকিছু। কারণ আগামী কাল জন্ম নেয় আজকের ভেতর থেকে; এটি কোনো আলাদা সময় নয়, বরং আজকের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি কাজ ও প্রতিটি অনুভূতির ধারাবাহিক ফল। “আগামী কাল শুধু আজকের জন্য”—এই বাক্য তাই কেবল সময়চেতনার নয়, এটি এক নৈতিক দর্শন। এটি শেখায়, ভবিষ্যতের দায় আজকের হাতে। আজকের অন্যায়, অবহেলা বা দুর্বলতা—সবই আগামী কালের বিপর্যয়ের বীজ বয়ে আনে। আবার আজকের সততা, পরিশ্রম ও ভালোবাসা—সবই আগামী কালের আলোর উৎস হয়ে ওঠে। তাই আজকেই বাঁচো গভীরভাবে, সচেতনভাবে, সততার সঙ্গে। আজকেই করো জীবনের কেন্দ্র। মনোযোগ দিয়ে কাজ করো, ভালোবাসো, ক্ষমা করো, সৎ থেকো—তবেই আগামী কাল তোমার নিজের হাতে তৈরি হবে। কারণ সত্যিকার অর্থে, আগামী কাল বলে কিছু নেই—শুধু আছে আজ, আর আজের ভেতরেই লুকিয়ে আছে সব আগামী কালের প্রতিশ্রুতি, সম্ভাবনা ও মুক্তি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের যাত্রা তাই একটাই প্রশ্নে এসে ঠেকে— “আমি কি আজকে বেঁচে আছি, নাকি আগামী কালের জন্য শুধু প্রস্তুতি নিচ্ছি?” যেদিন মানুষ এই প্রশ্নের সামনে সৎভাবে দাঁড়াতে পারবে, সেদিনই সে বুঝবে— আগামী কাল শুধু আজকের জন্য। লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ডেল্টা টাইমস্/রহমান মৃধা/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |