মরণোত্তর দেহ দান করতে ফেসবুকে পোস্ট কাস্টমস কর্মকর্তার
ডেল্টা টাইমস ডেস্ক:
|
মরণোত্তর দেহ দান করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন উপকমিশনার (কাস্টমস,এক্সসাইজ অ্যান্ড ভ্যাট) শায়েখ আরেফিন। ২৯ তম বিসিএসের মাধ্যমে ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করেন এ কর্মকর্তা। সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) তার ফেসবুক টাইমলাইনে মরণোত্তর দেহ দান করার আগ্রহ প্রকাশ করে একটি পোস্ট করেন তিনি । তার ফেসবুকে দেয়া পোস্ট পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো মরণোত্তর দেহ দান করলাম ![]() মরণোত্তর দেহ দান করতে ফেসবুকে পোস্ট কাস্টমস কর্মকর্তার পৃথিবীতে বহু মিথ্যে স্বতঃসিদ্ধ সত্যরূপে (Axiomatic truth) প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এসব 'সত্য' প্রশ্নের সম্মুখীন হয় না কখনো। এই 'সত্য'গুলোকে ভিত্তি ধরে তার উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিচিত্র নৈতিকতা। ফলে প্রতিষ্ঠিত সত্য আর নৈতিকতা, উভয়ই হয়ে উঠেছে মানুষের বোধ ও মনস্তত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা হচ্ছে, মরে গেলে মানুষ পৃথিবীকে কিছু দিতে পারে না, দেয় কেবল জীবদ্দশায় ও দিতে পারে নিঃস্বার্থেও। সত্য হচ্ছে উল্টোটা, মৃত্যুর পরও মানুষ দিতে পারে এবং তা অবশ্যই নিঃস্বার্থে। আর বেঁচে থাকতে যা দেয় তা নিঃস্বার্থে নয়, বিনিময়ে, আবার কখনো উপজাত (By product) হিসেবে। উল্লেখ্য, তাই বলে জীবদ্দশায় রাখা অবদানকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। ধরা যাক, মাদার তেরেসা জীবনব্যাপী কষ্ট স্বীকার করে নিঃস্বার্থে মানুষের সেবা করেছেন বলে বলা হয়ে থাকে। তিনি কি প্রকৃতই নিঃস্বার্থে করেছেন? বৈষয়িক দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃস্বার্থ মনে হলেও তিনি করেছেন স্বার্থের বিনিময়ে। তিনি মানুষের সেবা করে পরিতৃপ্ত হয়েছেন; এই পরিতৃপ্তি প্রাপ্তিই তাঁর স্বার্থ। এখানে কষ্টের বিনিময় হচ্ছে 'তৃপ্তি অর্জন'। কোনো মা যখন রাত জেগে শিশুকে দুধ পান করায় তখন সে ওতে আনন্দ পায়, সুখ পায়, তৃপ্তি পায়;বলেই কষ্ট স্বীকার করে, অন্যথায় সে অতৃপ্ত হতো। মা কষ্টের বিনিময়ে পায় আনন্দ, সুখ, তৃপ্তি। এ হচ্ছে কষ্টে আনন্দ। মানুষ 'পাওয়া' বলতে বস্তুগত বা বৈষয়িক পাওয়াকেই বোঝে, তাই বিপত্তি বাঁধে। আবার বৈষয়িক স্বার্থের দিক থেকে দেখলে দেখা যায়, মানুষ বিচিত্র পেশা গ্রহণ করে তার জীবিকার জন্যে; জীবিকার্জনের লক্ষ্যে প্রদত্ত শ্রমে যে-উপযোগিতা সে সৃষ্টি করে তা হচ্ছে উপজাত। পৃথিবীর কথা ভেবে সে শ্রম দেয়নি, দিয়েছে নিজের প্রয়োজনে, যা তৈরি করেছে কোনো-না-কোনো উপযোগ, পরিণামে হয়েছে কোনো কল্যাণ। কাজেই প্রমাণিত হয়, জীবদ্দশায় কৃত মানুষের প্রতিটি কাজের কেন্দ্রে রয়েছে স্বার্থ বা বিনিময়, হতে পারে তা বস্তুগত অথবা মনস্তাত্ত্বিক। মানুষ কেবল মৃত্যুর পরই পরিপূর্ণ নিঃস্বার্থে পৃথিবীকে দিতে পারে। মানুষের মৃতদেহ কোনো আবর্জনা নয়, খুবই উপকারী বস্তু, লাগতে পারে মানুষের কল্যাণে। দেহের অনেক অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে শিখেছে মানুষ; চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবচ্ছেদবিদ্যা ও কঙ্কালের ব্যবহার অপরিহার্য। এমনকি পচিত মাংস গাছ-লতাপাতার কাজে লাগে। কত বিচিত্র উপকারিতা রয়েছে মৃতদেহের! কিন্তু মানুষ মরেও যেন টিকিয়ে রাখতে চায় দেহ! সে দান করতে চায় না। এই না-চাওয়ার পেছনে ধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জনকল্যাণে মৃতদেহের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক রাষ্ট্রীয় আইন করে মৃতদেহের অপচয় রোধ করা উচিত বলে মনে করি। একদিন হবে। মানুষ যখন ধর্মমুক্ত হবে, কুসংস্কারমুক্ত হবে, পরিপূর্ণ সেক্যুলার হবে, তখন আইন হবে; তখন না হলেও ক্ষতি হবে না, মানুষ স্বেচ্ছায়ই তখন দান করে মহিমান্বিত করবে নিজের মৃতদেহকে। প্রাচীনকালে মৃতদেহের উপযোগিতা সম্পর্কে মানুষ জানতো না। তাই মাটিতে পুঁতে ফেলতো বা আগুনে পোড়াতো। কেনান অঞ্চলে চালু ছিল পুঁতে ফেলার রীতি আর ভারতীয় অঞ্চলে পুড়িয়ে ফেলার। এই রীতির মধ্যে একসময় ঢুকে পড়ে অলৌকিকতা, আর তখন তা রূপান্তরিত হয় ধর্মে। তাই দেখা যায় কেনান অঞ্চলের ধর্মাশ্রয়ীরা, ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলমানেরা, সমাহিত করে, ভারতীয় অঞ্চলের ধর্মাশ্রয়ীরা, হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈনেরা, পুড়িয়ে ফেলে। সবই আঞ্চলিক সংস্কৃতি থেকে উত্থিত। আমি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিনিধি ডাক্তার, আমি ডাক্তারের ব্যবস্হাপত্র অনুসারে চলছি। আমাকে আরও সহযোগিতা করছে পদার্থবিজ্ঞান-- থার্মোমিটার, অক্সিমিটার, ফ্লাস্ক, ভেপোরাইজার প্রতিমুহূর্তে কাজে লাগছে। আমি কৃতজ্ঞ বিজ্ঞানের কাছে। চিকিৎসা নিতে নিতে ভাবছি জীবন-মৃত্যুর কথা। আমি এখন আছি, একদিন থাকবো না, অনুপস্থিত হয়ে যাবো-- তখন আমি জানবোই না যে আমি ছিলাম! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমি 'বাঁধন' নামের স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের একটি সংগঠনের সদস্য ছিলাম, বহুবার রক্ত দান করেছি। মরণোত্তর দেহদানের কথাও অক্রিয়ভাবে ভেবেছি, আজ সক্রিয়ভাবে ভাবছি। আমি চাই না মৃত্যুর পর আমার দেহ সরাসরি কীটের খাদ্য হোক, অবমূল্যায়িত হোক, অপচয়িত হোক। আমি চাই দেহকে মানুষের কল্যাণে দান করতে। আমার সিদ্ধান্ত: আমি আমার মৃত্যু-পরবর্তী শরীর চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দালিলিকভাবে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা গেলে ভালো হতো। কিন্তু সঙ্গনিরোধকালে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা ঝুঁকিপূর্ণ হবে বিধায় তা এখন বাদ দিচ্ছি। আমি এই উন্মুক্ত ফোরামে ঘোষণা দিয়ে রাখছি, আমার ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় থাকা যে-কেউ উদ্যোগী হয়ে আমার সিদ্ধান্ত/ইচ্ছা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারেন। ঘোষণা: এতদ্দ্বারা আমি এই সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করছি যে, আমি চিকিৎসাবিজ্ঞান তথা মানুষের কল্যাণ সাধিত হয় এমন যেকোনো কাজে মরণোত্তর দেহ দান করলাম।মৃত্যুর পর কোনো ধর্মরীতিতে দেহ সৎকারের প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদান্তে, শায়েখ আরেফিন (এই টাইমলাইনের সত্ত্বাধিকারী)। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করেন এ কর্মকর্তা। তার হোম টাউন সিরাজগঞ্জ। শায়েখ আরেফিনের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া ডেল্টা টাইমস/এমআর/সিআর/জেডএইচ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |