অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এত দিন ধরে বড় দুটি দল ছিল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এর বাইরে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য কিছু দল পরিমাণগত দিক দিয়ে কাছাকাছি ছিল। পরিমাণের দিক দিয়ে রাজনীতিতে এসব দলের কমবেশি নানা ধরনের প্রভাব আছে বা ছিল। বিশেষত গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছে। সরকারে থাকাকালে গুম, খুন, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের বিচার ছাড়া তাদের নিয়ে রাজনৈতিক আলাপের আপাতত কোনো প্রয়োজনিয়তা নেই। আওয়ামী লীগ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত কী পরির্তন হয়েছে, তা বুঝতে হলে সংস্কার কমিশনের বৈঠকগুলোর দিকে আমরা নজর দিতে পারি। দীর্ঘ সময় নিয়ে চলা অসংখ্য বৈঠকে একটি দৃশ্য নিশ্চয় সবাই খেয়াল করেছেন। সেটি হলো বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বিএনপির পক্ষ থেকে সব বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অন্যান্য দলের পক্ষ থেকে সাধারণত প্রতিনিধি পরিবর্তন করা হয়েছে। বিশেষত নতুন দল এনসিপির কথা যদি বলি, জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রেও মিয়া গোলাম পরওয়ারকে বেশির ভাগ বৈঠকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সরব উপস্থিত ছিল সালাহউদ্দিন আহমদের। তিনি যে সব ফোকাস কেড়ে নিয়েছেন, এর কারণ তাঁর প্রজ্ঞা। যে বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন, তা সব সময় ছিল আইন ও সংবিধান মোতাবেক। নির্দিষ্ট ধারা, ব্যাখ্যা, এর উপযুক্ত ব্যবহার উল্লেখ করে তিনি তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন। অন্যরা সাধারণ অর্থে শুধু দাবিদাওয়া জানিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। অন্য দলের সঙ্গে বিএনপির এই পার্থক্য একটি বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে, সেটি হলো পরিবর্তনের বিষয়ে তারা আন্তরিক। তারা দীর্ঘ অধ্যয়ন, বিশ্লেষণের মাধ্যমে দলের পক্ষ থেকে একটি মতামত তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি বিষয়ে দলের একেক নেতার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দেওয়ার যে পরিচিত চিত্র, তা থেকে বিএনপি বের হয়ে এসেছে। এই পরিবর্তনের দিকটি অত্যন্ত ইতিবাচক। অন্যান্য দলের তুলনায় বিএনপির যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, দূরদৃষ্টি, আইন ও সংবিধানকে বুঝতে পারার ক্ষমতা, তা অন্য দলগুলোতে অনুপস্থিত দেখা গেছে। তারচেয়ে বড় বিষয়, বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপি নিজের অবস্থান থেকে ছাড় দিয়েছে। যেমন-এক ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী থাকার মেয়াদ নিয়ে বিএনপি তাদের অবস্থানকে অন্যদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে পরিবর্তন এনেছে। অন্যরা যেমন এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিষয়ে একাট্টা ছিল, বিএনপি সেখানে যৌক্তিক অবস্থান নেয়। কারণ দেখা গেল বিশেষ রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার অল্প কয়েক মাসেই দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর ওই অল্প কয়েক মাসের দায়িত্ব পালনকে কি একটি পূর্ণ মেয়াদ হিসাবে ধরা যাবে? যাওয়ার কথা না। তাহলে মূল বিষয় হলো, বাংলাদেশের হিসাবে দুই মেয়াদ মানে ১০ বছর। বিএনপি সেই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, যার যুক্তি না মেনে উপায় ছিল না অন্য দলগুলোর। গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলগুলোর দ্বারা বিএনপি সবচেয়ে বেশি অবিশ্বাস ও অপপ্রচারের শিকার হয়েছে,এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু তার পরও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনায় তিনবারের অভিজ্ঞ দলটি কোনো শক্তি প্রদর্শন ও বিভাজনের দিকে যায়নি। তারা সব সময় ঐক্যের ডাক দিয়ে এসেছে।জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানেও তারা সব দল-মতকে নিয়ে অনুষ্ঠান করেছে। অন্য সব দলের তুলনায় আকারে বড় হওয়ার পরও বিনয়ী এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আহবানই বিএনপি বারবার জানিয়ে আসছে। এসব ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা যদি স্মরণ করি আওয়ামী লীগকে, তাহলে কী দেখতে পাব? অন্যান্য দলকে হেয় করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, দমন করার সব রকমের আয়োজন তাদের ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও আটকে ছিল ওই জায়গায়। সেখান থেকে উত্তরণের জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর দরকার ছিল ইতিবাচক পথে হাঁটা। বিএনপি সেই কাজটি করে দেখাচ্ছে।তবে তাদের এই পরিবর্তন ঘটছে প্রাকৃতিক ভাবে। কোনো ধরনের বানোয়াট বা কৃত্রিম পদ্ধতিতে নয়। তাদের দলে গ্রপিং, অনিয়ম, চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নেই, তা নয়। তবে সেগুলোও তারা মোকাবেলা করছে। অভিযুক্তদের দল থেকে বহিষ্কার করছে, কোথাও মামলা করছে। এভাবে ধীরে ধীরে একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক দল গঠনের যে প্রক্রিয়া বাংলাদেশে তারা দেখিয়েছে গত কয়েক বছরে, তা সত্যি অভাবনীয়।একই সঙ্গে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদার, সেক্যুলার, সবার অংশগ্রহণের বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিএনপির একনিষ্ঠ ও আপসহীন তৎপরতাও আমরা দেখছি। বিভিন্ন বিষয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য, বিবৃতি আমাদের মনে একটি আধুনিকমনস্ক, উদার, সেক্যুলার রাজনৈতিক দলের অবয়ব ফুটিয়ে তুলছে, যদিও তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল এসব বিষয়ে পাল্টা প্রোপাগান্ডা ছড়াতে দ্বিধা করছে না।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী সনাতন, অপ্রগতিশীল রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার বিকাশের ক্ষেত্রে তারেক রহমানের বক্তব্যকে প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছে। তারা বিদ্বেষ ও বিভেদের ক্ষেত্র রচনা করছে। তবে এখানেও উল্লেখযোগ্য যে বিএনপির পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব বিষোদগারকে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। তারা গণতান্ত্রিক পরিবেশের পক্ষে কথা বলছে। বিএনপির তৎপরতায় এটিই মনে হচ্ছে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বহুল আকাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক পরিবর্তন খুবই সম্ভব। সংস্কারের ব্যাপারে বিভিন্ন দলের মধ্যে ঐক্য থাকলেও ঠিক কতটুকু সংস্কার হলে নির্বাচন দেওয়া যাবে, এ নিয়ে রয়েছে ব্যাপক অনৈক্য। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং তৎকালীন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ছাড়া বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ঐকমত্য কমিশন।নানা সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে একজন ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন তার সময়সীমা নির্ধারণ, দ্বি-স্তরের সংসদ প্রবর্তন এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ার মতো বিষয়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী শর্তসাপেক্ষে কিছু ব্যাপারে একমত হয়েছে, তবে মৌলিক সাংবিধানিক সংস্কারের নানা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা জটিল আকার ধারণ করেছে। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে চায়, অন্যদিকে বিএনপি শুরুতে ডিসেম্বর ও পরবর্তীতে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে।অন্যদিকে,সংস্কার ইস্যুতে এনসিপির বেশিরভাগ মতামতই জামায়াতের ইসলামীর সঙ্গে মিলে যায়। যেখানে, সংস্কারের ইস্যুটি দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা ছিল, কিন্তু তার বদলে এটি নিয়েই আলোড়ন তৈরি হয়েছে। যারা সংস্কার দেখতে চায় এবং আরও সময় দিতে চায় এবং যারা মনে করে যে এখনই সময় এসেছে সবকিছু শেষ করে নির্বাচনের উপর মনোযোগ দেওয়ার, তাদের মধ্যে বিভক্তি এখন স্পষ্ট। অন্যদিকে, ভারতের আচরণে তার পুরনো মিত্র হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কারণে ক্ষুব্ধতাই ফুটে উঠেছে। বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণে ঢাকার অনুরোধেও সাড়া দেয়নি ভারত। উল্টো, হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশিদের ভিসা দেয়া কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। তবে পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাতিসংঘের কাছ থেকে ড.মুহাম্মদ ইউনূস এখনও শক্ত সমর্থন পাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, বিভিন্ন পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার যে নীতি বাংলাদেশ এতদিন অনুসরণ করে এসেছে, ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারও সেই পররাষ্ট্রনীতিই অব্যাহত রাখবেন। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |