ধর্ষকের সঙ্গে পুলিশের হাসি: রাষ্ট্রের নৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রতিচ্ছবি
আবুল কালাম আজাদ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫, ১১:২৮ এএম আপডেট: ২৩.১০.২০২৫ ১১:২৯ এএম

ধর্ষকের সঙ্গে পুলিশের হাসি: রাষ্ট্রের নৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রতিচ্ছবি

ধর্ষকের সঙ্গে পুলিশের হাসি: রাষ্ট্রের নৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রতিচ্ছবি

ধর্ষণ—একটি শব্দ, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে নারীর আর্তচিৎকার, সমাজের ব্যর্থতা আর রাষ্ট্রের বিবেকহীনতা। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে চোখে পড়ে—“ধর্ষণ”, “গণধর্ষণ”, “ধর্ষণের পর হত্যা”। সমাজ যেন এই শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মানুষ কয়েক মুহূর্তের জন্য দুঃখ পায়, তারপর আবার রুটিনমাফিক জীবনে ফিরে যায়।

কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী শ্রীশান্ত রায়—যার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের অভিযোগ উঠেছে—তাকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশের হাসিমুখে তার সঙ্গে কথা বলার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। মুহূর্তেই প্রশ্ন ওঠে— “একজন ধর্ষণ অভিযুক্তের সঙ্গে পুলিশ হাসছে কেন?”

ধর্ষণ কেবল একটি অপরাধ নয়; এটি এক নারীর মানসিক মৃত্যুর নাম। যখন একজন নারী বিচার না পেয়ে সমাজের কাছে হাহাকার করে, তখন সেটি আমাদের সভ্যতার মুখে থাপ্পড়। অথচ যাদের দায়িত্ব এই অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া, সেই পুলিশই কখনও অভিযুক্তের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করে বসে।

কেউ কেউ বলেন—“পুলিশ তো পেশাদারভাবে কাজ করেছে।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন “পেশাদারিত্ব” যদি ভুক্তভোগীর মনে অপমানের বোধ জাগায়, যদি সমাজে ভুল বার্তা যায় যে ধর্ষকও হাসিমুখে আইনকে ফাঁকি দিতে পারে—তাহলে সেটি কি সত্যিই পেশাদার আচরণ?

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বহুদিন ধরেই জনআস্থা সংকটে ভুগছে। একদিকে অপরাধ দমন ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলে, অন্যদিকে ক্ষমতাশালীদের প্রতি নমনীয় আচরণের অভিযোগও নতুন নয়।

একজন ধর্ষণ অভিযুক্তকে যখন পুলিশ হাসিমুখে নিয়ে যায়, তখন তা কেবল একটি ছবি নয়; এটি রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান প্রকাশ করে।
সেই হাসি যেন বলে—“ধর্ষণ এখন খুব বড় কিছু নয়।” সেই হাসি যেন বলে—“তুমি তো প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে, তোমার কিছুই হবে না।”

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রায় ১,২০০ নারী ও শিশু—এর মধ্যে ৭০ জনের বেশি ধর্ষণের পর নিহত। এই সংখ্যার বাইরে রয়েছে হাজারো নীরব কান্না, যা কোনো রিপোর্টে আসে না। কারণ তারা জানে, বিচার চাওয়াই হয়তো নতুন অপমান ডেকে আনবে।

যখন তারা পুলিশের হাসি দেখে, তাদের নীরবতা আরও গভীর হয়। তারা ভাবে—“এই দেশে বিচার চাওয়া মানেই নিজের আরও অপমান।”

শ্রীশান্ত রায় বুয়েটের শিক্ষার্থী। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বের হয় দেশের সবচেয়ে মেধাবী তরুণরা। অথচ এখানেই যদি কেউ নারীর প্রতি ঘৃণা, কটূক্তি আর যৌন সহিংসতার মানসিকতা লালন করে, তবে প্রশ্ন জাগে—আমাদের শিক্ষা কি মানুষ তৈরি করছে, নাকি কেবল ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ার?

যে শিক্ষার্থী নারীদের অপমান করতে আনন্দ পায়, সে আমাদের সমাজের বিকৃত প্রতিচ্ছবি। আর যখন সেই শিক্ষার্থীকে পুলিশের সঙ্গে হাসতে দেখা যায়, সেটি যেন পুরো সমাজেরই এক ভয়াবহ আয়না—যেখানে আমরা নিজেদের নৈতিক দেউলিয়াত্ব দেখি।

পুলিশ শুধু অপরাধী ধরার বাহিনী নয়; তারা ন্যায়বিচারের প্রতীক। তাদের প্রতিটি আচরণ সমাজে বার্তা পাঠায়—রাষ্ট্র কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।
যখন পুলিশ অপরাধীর সঙ্গে হাসে, মানুষ ভাবে—রাষ্ট্রও হাসছে। আর যখন পুলিশ নির্যাতিতের পাশে দাঁড়ায়, তখন মানুষ বিশ্বাস করে—রাষ্ট্র এখনো ন্যায়বিচারে অটল।

এই ঘটনাকে উদাহরণে পরিণত করার সুযোগ ছিল পুলিশের। তারা কঠোরভাবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বলতে পারত—“ধর্ষণের জায়গা বাংলাদেশে নেই।” কিন্তু তারা যা করেছে, তা সমাজে ভুল বার্তা পাঠিয়েছে—যে ধর্ষকও পুলিশের বন্ধু হতে পারে।

এখানে দোষ শুধু পুলিশের নয়; এটি আমাদের সমাজের মানসিক রোগ। অপরাধী ধরা পড়লে কেউ বলে, “একটা সুযোগ দাও।” আর ভুক্তভোগী নারী যদি প্রতিবাদ করে, তখন প্রশ্ন ওঠে—“সে রাতে বাইরে কেন গিয়েছিল?”

এই চিন্তাভাবনাই আমাদের বিবেককে হত্যা করছে। আমরা ধর্ষণের ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিই, প্রতিবাদ করি, হ্যাশট্যাগ চালাই—তারপর ভুলে যাই। ভুলে যাই, প্রতিটি ধর্ষণ মানে একটি পরিবারের ভাঙন, এক জীবনের চূড়ান্ত অপমান।

রাষ্ট্রের উচিত পুলিশের এই আচরণের তদন্ত করা। যারা অভিযুক্তের সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তুলেছেন, তাদের জবাবদিহিতায় আনা প্রয়োজন। কারণ এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত ভুল নয়; এটি একটি রাষ্ট্রীয় বার্তা—যা ভুক্তভোগীদের নিরাশ করে, অপরাধীদের সাহস জোগায়।

নাগরিক সমাজেরও নীরব থাকা চলবে না। আমাদের বলতে হবে— “না, পুলিশের হাসি আমাদের কান্নাকে ঢাকতে পারে না।” যে রাষ্ট্রে ধর্ষক হাসতে পারে, সেই রাষ্ট্রে মায়ের চোখের জল শুকায় না। যে সমাজে পুলিশ অপরাধীর পাশে হাসে, সেখানে ন্যায়বিচার শব্দটি অর্থহীন হয়ে পড়ে।

তবু এখনো সময় আছে— রাষ্ট্র চাইলে পুলিশের আচরণবিধি পুনর্গঠন করতে পারে, মানবিক প্রশিক্ষণ জোরদার করতে পারে, এবং সমাজে বার্তা দিতে পারে—ধর্ষণ কোনোভাবেই সহনীয় নয়।

যেদিন পুলিশ ভুক্তভোগীর চোখের দিকে তাকিয়ে দায়িত্ব পালন করবে, যেদিন অপরাধীর মুখে হাসির বদলে ভয় দেখা যাবে— সেদিনই বদলাবে বাংলাদেশ। কারণ, ধর্ষকের সঙ্গে পুলিশের হাসি মানে ভুক্তভোগীর কান্নাকে উপহাস করা। আমরা চাই এমন বাংলাদেশ, যেখানে ন্যায়বিচার হাসবে—ধর্ষক নয়।




লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিস্ট।

ডেল্টা টাইমস/আবুল কালাম আজাদ/সিআর

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com