গণতন্ত্রে উত্তরণে তারেক রহমানের যত চ্যালেঞ্জ
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() গণতন্ত্রে উত্তরণে তারেক রহমানের যত চ্যালেঞ্জ আগামী নির্বাচন যদি সত্যিই ফেব্রুয়ারিতে হয়, তাহলে সামনের সময়টা খুবই কম। এমনকি যে সময় আছে তা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, আর এ ক্ষেত্রে বহুমুখী সংকট থেকেই যাবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খালি চোখে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো চূড়ান্ত ঐকমত্য দেখতে পাচ্ছি না। বাংলাদেশের তরুণ ভোটাররা নির্বাচনের অন্যতম বড় শক্তি। তাদের প্রত্যাশা উন্নত শিক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ। কিন্তু রাজনীতির মূল স্রোতে তাদের চাহিদা প্রতিফলিত হয় না বললেই চলে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল তরুণদের কেবল প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে না। অথচ তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ ছাড়া জন-আকাঙ্ক্ষার নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে যদি শুধু একটি ভোটাধিকার কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তবে তা মানুষের গভীর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবে না।এমনকি সুশীল সমাজ,নাগরিক সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে। গণমাধ্যমের স্বাধীন ভূমিকা নির্বাচনি অনিয়ম উন্মোচনে সহায়তা করতে পারে। যদি নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছভাবে কাজ করে এবং রাজনৈতিক দলগুলো ন্যূনতম আস্থার ভিত্তিতে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়, তবে এ নির্বাচন একটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। তবে আশঙ্কার জায়গাও আছে। ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলো যদি তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা না করে এবং নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে নির্বাচন আবারও বিতর্কিত হয়ে পড়তে পারে। তখন জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হবে, যা ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও দুর্বল করবে। একইভাবে, নির্বাচনি সহিংসতা ও অর্থের প্রভাব যদি রোধ করা না যায়, তবে সাধারণ ভোটারদের অংশগ্রহণ কমে যাবে। ভোটাররা যদি মনে করেন তাদের ভোটের কোনো মূল্য নেই, তবে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা পুনর্গঠন অসম্ভব হয়ে উঠবে। জন-আকাঙ্ক্ষার নির্বাচনের মূল শর্ত হলো অংশগ্রহণ মূলক গণতন্ত্র। জনগণকে শুধু ভোট দেওয়ার জন্য ডাকা হবে, আর তাদের মতামত ও দাবি উপেক্ষিত হবে-এটি জনগণ আর মেনে নেবে না। তাই প্রয়োজন নির্বাচনি সংস্কার। প্রার্থিতা যাচাই, স্বচ্ছ সম্পদ ঘোষণা, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, নির্বাচনি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ-এসব সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমের প্রতিটি ধাপে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে, যাতে জনগণ দেখতে পায় তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।একইভাবে, নির্বাচনি সহিংসতা ও অর্থের প্রভাব যদি রোধ করা না যায়, তবে সাধারণ ভোটারদের অংশগ্রহণ কমে যাবে। ভোটাররা যদি মনে করেন তাদের ভোটের কোনো মূল্য নেই, তবে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা পুনর্গঠন অসম্ভব হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতাও এখানে অপরিসীম। তারা যদি শুধু ক্ষমতা দখল বা ধরে রাখার রাজনীতি চালিয়ে যায়, তবে জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। প্রয়োজন সমঝোতা, সংলাপ ও আপস। একে অপরকে শত্রু ভেবে দূরে ঠেলে দেওয়া নয়, বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও তরুণ প্রজন্ম চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যাতে রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য হয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে। অবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন কেবল একটি ভোটাভুটি নয়, বরং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনর্গঠনের একটি সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগানো গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি শক্তিশালী ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে পারবে। আর যদি রাজনৈতিক বিভাজন ও অবিশ্বাসের দেয়াল ভাঙা না যায়, তবে এ নির্বাচনও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হবে। সাম্প্রতি তারেক রহমানের বিবিসির সাক্ষাৎকারটি সাধারণ জনগণ, বুদ্ধিজীবী মহল ও বিএনপির নেতা কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। যদিও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা কিছুটা সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কারণ তাঁরা জানেন, তারেক রহমান শুধু বিএনপির ক্ষতিগ্রস্ত ভাবমূর্তি পুনর্গঠন করতে পারবেন না, বরং এমন এক রাজনৈতিক ঢেউ তুলতে পারেন, যা প্রতিদ্বন্দ্বীরা রুখে দাঁড়াতে পারবে না। সাক্ষাৎকারের শুরুতেই গণমাধ্যমে তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতি নিয়ে করা প্রশ্নের উত্তরে তারেক রহমান মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি নিজের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং সূক্ষ্মভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় তাদের অঙ্গীকারের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বিএনপি শাসনামলে সংবাদ- পত্রের স্বাধীনতার কথা স্মরণ করিয়ে আশ্বাস দেন যে ভবিষ্যতেও সেই স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকবে। বিএনপি মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তিনি বলেন, যেসব আইন ও অধ্যাদেশ স্বাধীনতা সীমিত করে, আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে সেগুলো সংস্কার করা হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধেও তিনি সতর্ক করেন এবং গণমাধ্যমকে অনুরোধ করেন যেন কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা সংবাদ হিসেবে প্রচার না পায়। জুলাই বিপ্লব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফল এবং বিগত দশকের একনায়কতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামের পরিণতি। তিনি শহীদ ও আহতদের পরিবারের পাশে সহমর্মিতা ও বিনয়ের সঙ্গে দাঁড়ানোর আহবান জানান এবং জুলাই অভ্যুত্থানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অবদানকে স্বীকৃতি দেন। নির্বাচন ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে তারেক রহমান স্পষ্টভাবে বলেন, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব জনগণের। জনগণের হাতে সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো নির্বাচন। তারেক রহমান রাষ্ট্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির ওপর জোর দেন। সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর জোট গঠন ও রাজনীতি করার স্বাধীনতাকে তিনি স্বাগত জানান। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মনোভাবকেও তিনি গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেন এবং পুনরায় বলেন, বিএনপি বহুদলীয় রাজনীতি ও জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী। এ মুহূর্তে দেশ যেভাবে এক গভীর রাজনৈতিক অভিভাবকহীনতার মধ্যে নিমজ্জিত, সেখানে তারেক রহমানের নেতৃত্ব অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তিনি শুধু একটি দলের নেতা নন; তিনি এমন এক চিন্তার ধারক, যা জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের পুনর্গঠনে সক্ষম। তবে এ পথ সহজ নয়। রাজনৈতিক বাস্তবতা জটিল ও বিপজ্জনক। বহু বছর ধরে প্রচলিত প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি, দুর্নীতি, দলীয়করণ, প্রশাসনিক স্বচ্ছতার অভাবসবই একটি নৈতিক পুনর্জাগরণের পথে বড় বাধা। তারেক রহমান এ বাধা অতিক্রমের জন্য জোর দিয়েছেন কঠোর দুর্নীতি দমন, রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও দলীয় কাঠামোর সংস্কারে। তার বিশ্বাস, নেতৃত্বের যোগ্যতা আসে নৈতিকতা থেকে, এবং দলের শক্তি আসে জনগণের আস্থা থেকে। এজন্য তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়; এটি জনগণের দায়িত্ব।’এ বক্তব্যের মধ্যেই নিহিত আছে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। একটি রাষ্ট্র তখনই টিকে থাকে, যখন সেখানে রাজনীতি হয় দায়িত্বের, নয় প্রাপ্তির।বাংলাদেশের আজ সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেই দায়িত্ববোধ সম্পন্ন নেতৃত্ব, যারা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়, জাতির নিরাপত্তা নিয়ে ভাববে। তারেক রহমানের রাজনৈতিক যাত্রা এক অনন্য প্রতিরোধের ইতিহাস। নির্বাসনের বছরগুলো তার জন্য যেমন কষ্টের, তেমনি আত্মবিশ্লেষণের সময়ও ছিল। এ সময়ই তিনি রাজনৈতিক চিন্তায় পরিণত হন। অভিজ্ঞতা তাকে দিয়েছে ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি। আজ তার চিন্তায় যে পরিণত রাজনীতি আমরা দেখি, তা কোনো আকস্মিক প্রাপ্তি নয়; এটি সময়, যন্ত্রণা ও সংগ্রামের ফসল। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি যদি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক হতে চায়, তবে প্রয়োজন হবে এমন এক নেতৃত্বের, যিনি জনগণকে একত্রিত করতে পারবেন। তারেক রহমানের সবচেয়ে বড় শক্তি এ ঐক্যবোধ। তিনি বারবার বলেছেন,'আমাদের লড়াই কোনো দলের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের লড়াই অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’এ বক্তব্যই তাকে একজন আদর্শবাদী নেতা হিসেবে আলাদা করে তোলে। বর্তমান বিশ্বে রাজনীতি ক্রমেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ব্যবসায়িক ও স্বার্থভিত্তিক হয়ে উঠছে। কিন্তু তারেক রহমানের রাজনৈতিক দৃষ্টি এ প্রবণতার বিপরীতে অবস্থান নেয়। তার কাছে রাজনীতি হলো জনগণের সেবা, রাষ্ট্রের মর্যাদা ও স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। তিনি বারবার বলেছেন, 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস নেই'। এ বক্তব্যে ফুটে ওঠে তার দেশপ্রেম, যা রাজনৈতিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে।বাংলাদেশের ইতিহাসে নেতৃত্বের অভাব কোনো নতুন বিষয় নয়, কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে এটি সবচেয়ে গভীর। কারণ, জনগণের মধ্যে এখন এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। তারা রাজনীতিকে আর আশা হিসেবে দেখে না, বরং ভয় হিসেবে দেখে। এ অবস্থায় যদি কোনো নেতা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেন, তবে সেটি হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের সূচনা। আর তারেক রহমান সেটি পারবেন বলে জনগণের বিশ্বাস। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক,যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস্/রায়হান আহমেদ তপাদার/আইইউ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |