|
নিজের আদালতে নিজেই যখন অপরাধী
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() নিজের আদালতে নিজেই যখন অপরাধী শেখ হাসিনার অপরাধ এবং বিচার যেহেতু আন্তর্জাতিক মনোযোগ পেয়েছে, তাই একই ধরনের অপরাধ নিবৃত্তকারী হিসেবে এটার আন্তর্জাতিক প্রভাবও আছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল, সেগুলো নেহাত হত্যা কিংবা নির্যাতন না, এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ই না, তার শাসনামলের পুরোটা সময় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে নিয়মিত ভাবেই।তবে মানুষ স্মরণ রাখবে, এই অভ্যুত্থানে শুধু নয়, আওয়ামী শাসনের দীর্ঘ ১৫ বছর বিরুদ্ধাচরণ করে নিপীড়নের শিকার অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি এবং লুণ্ঠিত গণতন্ত্রের দেশে মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে রীতিমতো প্রজায় পরিণত হওয়া কোটি কোটি মানুষেরও এই রায়ের প্রতি নজর ছিল। এই রায় নিশ্চয়ই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছে। তবে প্রশ্ন আসতেই পারে, এই রায় কি শেষ পর্যন্ত প্রতীকী বিষয়ে পরিণত হবে? শেখ হাসিনার জীবদ্দশায় তাঁকে দেশে এনে রায় কার্যকর করা যাবে, এই সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। ভারত সরকার যেভাবে তাঁর আশ্রয় ও নিরাপত্তা বিধান করছে তাতে এটা প্রায় নিশ্চিত যে ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না। ভারতের মানসিকতার প্রমাণ পেতে পারি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টাসহ বাংলাদেশ বারবার আপত্তি জানানোর পরও ভারত শেখ হাসিনাকে ক্রমাগত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কথা বলায় বাধা দিচ্ছে না। এমনকি রায় ঘোষণার আগের দিনও তিনি তাঁর বক্তব্যে গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে মারাত্মক সব হুমকি দিয়েছেন।মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থানের কারণে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর জন্য ভারতের ওপর চাপ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব হবে। তবে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে সরাসরি ভারত সরকারের ওপর শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য চাপ তৈরি করা।ভারত সরকারকে ভাবতে হবে, তারা যদি শেখ হাসিনার সময়ের মতো শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক না করে একটি টেকসই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরির জন্য বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চায়, তাহলে শেখ হাসিনার ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে। রায় ঘোষণার আগে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানে প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করেন ট্রাইব্যুনাল। এমন এক সময়ে এই রায় দেওয়া হয়েছে, যখন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরেক আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। বহুল প্রতীক্ষিত এই রায় জাতীয় টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করা হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রথম জাতীয় নির্বাচনের আগে এই রায় দেওয়া হলো। গত বছরের গণ-অভ্যুত্থান দমনের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে ৭৮ বছর বয়সী পলাতক এই রাজনীতিবিদের অনুপস্থিতিতে তাঁর বিচার হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন। আমরা আশা করতে পারি, সরকার, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর আন্তর্জাতিক অবস্থানকে ব্যবহার করে এসব চাপ সামাল দিতে পারবেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনকে দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করানো শেখ হাসিনার বিচারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের একটা অসাধারণ সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। সেই তদন্তের রিপোর্টে সংস্থাটি জানিয়েছিল, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশে উচ্চমাত্রায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। এসব অপরাধের সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব, পরিচালনা এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাই ছিলেন প্রধান ব্যক্তি। সময়ই বলবে শেখ হাসিনাকে এনে রায় কার্যকর করা যাবে কি না, তবে সেটা করা না গেলেও এই রায়ের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হলো শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখানেই শেষ হচ্ছে। দল হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতে আওয়ামী লীগের বিচার হওয়ার কথা আলোচনায় আছে। আলোচনার সুবিধার জন্য যদি এটা ধরেও নিই যে, সেই বিচারে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংগঠন হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ না পেয়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হলো না। তারপরও এটা বলতেই হচ্ছে যে, বয়স শেখ হাসিনার পক্ষে নেই। আর এই রায়ের পর সেই প্রেক্ষাপট তৈরি হলেও বাংলাদেশে ফিরে এসে শেখ হাসিনার পক্ষে দলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা এবং নেতৃত্ব দেওয়া একেবারেই অসম্ভব হবে বলে মনে হয়। কিছু অডিও বক্তব্যের মাধ্যমে তাঁর পরাজিত চেহারা দেখাবেন না বলে তিনি ভিডিও বার্তায় আসবেন না সম্ভবত, তিনি হয়তো উসকানি দিয়ে যেতে পারবেন, যা আদতে তাঁর দলের প্রতি নেতিবাচক প্রভাবই ফেলবে। শেখ হাসিনা এবং তাঁর ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষদের অনেকটা চেনা আছে বলেই এটা অপ্রত্যাশিত নয় যে, তিনিসহ সেই সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা কোনোভাবে তাঁদের দায় স্বীকারের আশপাশেও যাবেন না। কিন্তু দলটির সমর্থকদের একটা বড় অংশ এখনো শেখ হাসিনা এবং তাঁর সহযোগীদের অপরাধের মাত্রা এবং ব্যাপ্তি অনুধাবন করছেন না; এটা হতাশার। এই রায় সাধারণ সমর্থকদের মনে কিছু ভিন্ন চিন্তার উদ্রেক করবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশের জনগণ। বর্তমান আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড ও অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হলে উপস্থাপিত প্রমাণ ও তাদের দায়িত্বের মাত্রা বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ড প্রযোজ্য কিনা-সেই সিদ্ধান্ত ট্রাইব্যুনালের বিচারকরাই নেবেন। এতে কি প্রত্যর্পণ আরও কঠিন হবে কিনা-সে বিষয়ে বলতে গেলে, এটা স্পষ্ট যে, মৃত্যুদণ্ড কিংবা কম দণ্ড দেওয়া হোক, ভারত শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করার কোনো ইচ্ছাই প্রকাশ করেনি। শেখ হাসিনা যদি ভারতে অবস্থান ছেড়ে তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রে ভ্রমণ করেন, তাহলে সেখানে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে কিনা-তা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের আইন এবং সে দেশে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি কোনো ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণে নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা তার ওপর। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মুখোমুখি হলেন। এই বিচার কি বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, নাকি নতুন রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেবে? যদিও বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এই বিচার সত্যিই নজিরবিহীন। প্রথমবারের মতো একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে-এটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে, সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের অপরাধের জন্য বিচারের অসংখ্য আন্তর্জাতিক উদাহরণ রয়েছে।লাইবেরিয়ার চার্লস টেলরের বিচার থেকে শুরু করে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার স্লোবোদান মিলোসেভিচ এবং সম্প্রতি ইসরাইল, সুদান এবং মিয়ানমারের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখিয়েছে যে, এই ধরনের গুরুতর অপরাধের জন্য জবাবদিহিতা রাজনৈতিক অবস্থান বা জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে। এই মামলাটি বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য নজির স্থাপন করবে, এই নীতিকে আরও শক্তিশালী করে যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়মুক্তি সহ্য করা হবে না-এই প্রতিশ্রুতি বিশ্বব্যাপী জোরদার করবে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |