|
গণতন্ত্র, সুশাসন এবং জনগণ
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() গণতন্ত্র, সুশাসন এবং জনগণ এর প্রতিটি পর্যায়ে সময়ের সঙ্গে জনগণের ভূমিকা নিম্নমুখী হলো, রাজনীতি অনেকটাই দলীয়করণ ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হারিয়ে গেল প্রভাবশালী গোষ্ঠীর শোরগোলে। ফলত রাষ্ট্র গঠনের যে স্বপ্ন ছিল জনগণের জন্য, তা অনেক সময় দলীয় কিংবা ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে রাজনীতির ভাষা অনেকটা দৃষ্টিকোণ পরিবর্তনের ফলে বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ ও দশের সেবা করার বুলি আওড়ানো অনেক রাজনীতিবিদের দেখা মিলে শুধুই ভোটের মৌসুমে। যেহেতু ঘনিয়ে আসছে জাতীয় নির্বাচন, রাজনীতির মাঠ তাই এখন ভোটের শোরগোলে ব্যস্ত। যেখানে আছে প্রত্যাশা, কৌশল, আবার আশঙ্কাও। যদিও নির্বাচন কমিশন এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করেনি, তবু বিভিন্ন দলীয় ও স্বতন্ত্র সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতিমধ্যেই নির্বাচনি এলাকায় ছুটে বেড়াচ্ছেন। গ্রাম থেকে শহর; সব জায়গায় শুরু হয়েছে প্রচার তোড়জোড়। প্রার্থীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন, দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। কিন্তু জনগণ খুব সহজে তা বিশ্বাস করছে না। কারণ বাস্তবতা হলো—নির্বাচনের পর প্রার্থীরা অনেক সময়ই হারিয়ে যান। অতীতে দেখা গেছে, ভোটে জয়ের পর অনেক নেতা জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না, উন্নয়নে ভাটা পড়ে এবং জনদরদি নেতৃত্বের জায়গা দখল করে নেয় আত্মস্বার্থ আর দলীয় রাজনীতি। তবে এটিও সত্য, অনেক জনপ্রতিনিধি এখনও আন্তরিকভাবে জনগণের কল্যাণে কাজ করছেন। কিন্তু সামগ্রিক চিত্রে দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিস্বার্থের প্রবণতা বেশি দৃশ্যমান। জনগণ এখন চায় এমন রাজনীতি, যেখানে সর্বস্তরে সুশাসন, ন্যায্যতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। অন্যদিকে রাজনীতিবিদদেরও আত্মসমালোচনার সময় এসেছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়া মানে কেবল কাক্সিক্ষত আসন পাওয়া নয়, বরং জনগণের আশা ও প্রয়োজন বুঝে সেগুলোর প্রতিফলন ঘটানো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাজনীতিতে এই দায়বদ্ধতা প্রায়ই অনুপস্থিত। নির্বাচনের সময় জনগণকে মনে রাখা হয় কিন্তু ক্ষমতায় গিয়েই ভুলে যাওয়া হয় তাদের কষ্ট, তাদের স্বপ্ন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে জনগণকে কেবল আমরা প্রত্যক্ষ করছি শুধু ভোটদাতা হিসেবে, সক্রিয় অংশীদার হিসেবে নয়। যদিও গণতন্ত্র কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি চলন্ত প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণ বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে এবং সরকারের কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করে। তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চায় ব্যাপক ঘাটতি আছে। তা ছাড়া আন্তঃদলীয় কোন্দল এবং বিরোধী মতকে অনেক সময় দমন করার রীতিও বহুল প্রচলিত। এই বিষয়গুলোর ফলে জনগণ রাজনীতিতে অনেকাংশে আস্থা হারাচ্ছে। ফলত রাজনীতি আর জনগণের থাকছে না, হয়ে উঠছে বিশেষ গোষ্ঠীর সম্পত্তি। আজকের রাজনীতি জনগণের জীবনের সঙ্গে কতটা সম্পর্কিত-এই প্রশ্নটি জরুরি। কেননা, রাজনীতির প্রতিটি সিদ্ধান্ত-ই দেশের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা ও জনগণের অংশগ্রহণের অভাব; উভয়কেই প্রতিফলিত করছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনগণ নিজস্ব মতামত দিচ্ছে, কিন্তু সেই আওয়াজ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। যখন রাজনীতি জনগণকেন্দ্রিক হয়, তখন স্থানীয় অভিজ্ঞতা ও চাহিদা নীতি প্রণয়নে প্রতিফলিত হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের সংযোগ কমে গেছে। ফলে নীতি তৈরি হয় অনেকাংশে প্রভাবশালী গোষ্ঠী এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ অনুযায়ী। রাজনীতির এই সংকটে তরুণদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও তরুণরা রাজনীতিতে যথাযথ প্রতিনিধিত্ব পায় না। স্থানীয় পর্যায় থেকে রাজনীতির মূলধারার আলোচনায় তারা একপ্রকার অনুপস্থিতই থেকে যায়। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-পৃথিবীর যত মহৎ কর্ম সাধিত হয়েছে, মুক্তির উদ্যম হাওয়া যত প্রান্তর বেয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তার প্রতিটির পেছনে অসামান্য অবদান রয়েছে তরুণদের। আমাদের দেশের বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে সেই চিত্রটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই জাতীয় পর্যায়ে তরুণদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না হলে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে দক্ষ ও উদ্যমী নেতৃত্ব বেশ সংকটে পড়বে বলেই ধারণা করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে। এক অর্থে বলা যায়, এটি অভূতপূর্ব ঘটনা। এর মাধ্যমে রাজনীতির পথযাত্রা মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। তবে জনগণের আকাক্সক্ষা ছিল প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আসবে, বাস্তবিক অর্থে তেমন মৌলিক পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়নি। জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কিছু রদবদল হয়েছে মাত্র। তবুও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখনও রাজনীতিতে আস্থা রাখে, বিশ্বাস করে পরিবর্তনের সম্ভাবনায়। প্রত্যাশা থাকে এমন রাজনীতির; যেখানে উন্নয়ন মানে কেবল অবকাঠামোগত সংস্কার নয় বরং কৃষকের ন্যায্যমূল্য ও শ্রমিকের মজুরি থেকে শুরু করে যুবকের কর্মসংস্থান, প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবায় সংস্কার, পরিবহনে শৃঙ্খলা, নদীশোষণ বন্ধ, সর্বত্র মাদক ও বখাটেপনা চিরতরে নির্মূল, বাকস্বাধীনতা, নারীর নিরাপত্তা ও ন্যায্য অংশগ্রহণ এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরের আইনের সুশাসন নিশ্চিত হবে। এই ক্ষুদ্র বিষয়গুলো মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করে এবং জনগণ এগুলোকেই বেশি মূল্যায়ন করে। সামষ্টিক উন্নতি মানুষকে সামগ্রিকভাবে তৃপ্ত করে বটে, তবে ক্ষুদ্র পর্যায়ের শান্তি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে। তাই এ পর্যায়ের তৃপ্তি জনগণের সঙ্গে সরকারের নৈকট্য বৃদ্ধি করে।এ ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে পরিত্রাণ দিতে হবে জনগণকে। বিগত নির্বাচনে ভয়-আতঙ্ক সৃষ্টিকারীদের রাজনীতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ। জনগণের মন থেকে সেই ভয়-আতঙ্ক দূর করার ব্যবস্থাও নিতে হবে। গ্রামে-গঞ্জে-শহরে সর্বত্র মানুষ এখন চায় শান্তির সুবাতাস। ভোটাররা এখন আগের চেয়ে যথেষ্ট সচেতন; তারা জানে একজন সৎ ও দক্ষ জনপ্রতিনিধি পুরো এলাকার চেহারা বদলে দিতে পারেন। গণতন্ত্রের মূল শক্তি যেহেতু জনগণ। তাই সেই শক্তিকে সক্রিয় রাখতে হলে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি দায়িত্বে অবহেলা করা যাবে না। জনগণকেও প্রশ্ন তুলতে হবে-নির্বাচিত প্রতিনিধি তার প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করেছেন? উন্নয়নের সুবিধা কারা পাচ্ছে? দুর্নীতি কেন থামছে না? একটি সচেতন জনগোষ্ঠীই তো পারে সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিকে প্রতিহত করতে।এখন প্রয়োজন এমন রাজনীতি,যেখানে উন্নয়ন হবে অংশগ্রহণ মূলক, সিদ্ধান্ত আসবে জনগণের মাঠঘাট থেকে, আর বাস্তবায়ন করবে জনপ্রতিনিধি। রাজনীতি হতে হবে এমন এক চুক্তি, যেখানে ভোটের বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি নয়, বরং বিশ্বাসের বন্ধনে সেই সম্পর্ক গড়ে উঠবে। ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক আন্দোলনের পর মানুষের মনোজগতে যে পরিবর্তন এসেছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে সেটি উপলব্ধি করতে হবে। যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যূনতম যে বৈশিষ্ট্যটি থাকা প্রয়োজন, তা হলো অবাধ,নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণ- মূলক নির্বাচন। নির্বাচন জনগণকে তাদের পছন্দমতো দল বা আদর্শ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয় আর রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে ক্ষমতার নিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তন দলগুলোকে জনতার চাহিদার প্রতি মনোযোগী করে তোলে। কিন্তু এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে নির্বাচন কেবল গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্তটুকু পূর্ণ করে এবং গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব বা সাফল্যের নিশ্চয়তা দেয় না। নির্বাচননির্ভর গণতন্ত্র বরং একটি দুর্বল গণতন্ত্র, যা যেকোনো সময় সংকটে পড়তে পারে। গণতন্ত্রের টিকে থাকা নির্ভর করে গণতন্ত্রকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ওপর। গণতন্ত্র অভিমুখে যাত্রায় বাংলাদেশ এখন এক ক্রান্তিকালে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি বেশ জোরেশোরেই উঠেছে এবং এখানে দ্বিমতের সুযোগ একেবারেই নেই। কিন্তু দাবি বা দাবি আদায় যদি শুধু নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে আবারও আমরা ফিরে যাব ১৯৯১ সালে-আবার শুরু করব এক অর্থহীন যাত্রা। দাবিনামায় তাই যুক্ত থাকুক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের কথাও। সুশাসনের দিকে নতুন যাত্রাপথের সূচনা শুধু তাতেই সম্ভব। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |