|
পশ্চিমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং নৈতিক চাপ
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() পশ্চিমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং নৈতিক চাপ রিপোর্ট রয়েছে যে, শুধু একটি প্রসূতি হাসপাতালে রোগী এবং তাদের পরিবারসহ প্রায় ৫০০ জন নিহত হয়েছে। যারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে তারা বলেছে, সংক্ষিপ্ত বিচারে বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আরএসএফ বেসামরিক নাগরিকদের এত নৃশংসভাবে হত্যা করেছে যে, রক্তভেজা মাটির ছবি স্যাটেলাইটেও ধরা পড়েছে। এল ফাশারের পতনের পরপরই হত্যাকাণ্ডের গতি ও তীব্রতা দেখে যুদ্ধ পর্যবেক্ষকরা তাঁকে রুয়ান্ডার গণহত্যার প্রথম ২৪ ঘণ্টার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এটি এমন একটি অভিযানের চূড়ান্ত পরিণতি, যেখানে শহরের লাখ লাখ মানুষকে ঘিরে ফেলে অনাহারের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। যারা পালানোর চেষ্টা করেছিল তারা মৃত্যু ও ধর্ষণের ঝুঁকি নিয়েছিল। যারা বেঁচে ছিল তাদের ওপর বোমা হামলা হয়; পশুখাদ্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না সেখানে। দারফুরে সুদানের সেনাবাহিনীর শেষ অবশিষ্ট ঘাঁটি ছিল এল ফাশার এবং গত সপ্তাহে সুদানের যুদ্ধ এক গুরুতর মোড় নেয়। আড়াই বছর ধরে দেশটির নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদানের সশস্ত্র বাহিনী (এসএএফ) এবং আরএসএফের মধ্যে নৃশংস লড়াই নিরলসভাবে চলছে। ২০১৯ সালে একটি জনপ্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ওমর আল-বশিরকে উৎখাত করার পর বেসামরিক নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে উভয় গোষ্ঠীই নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও জোট বেঁধে সুদান শাসন করছিল। একে অপরের বিরুদ্ধে যাওয়ার আগে এরা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালায়। যখন উভয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়,তখন তা বিস্ফোরকে রূপ নেয়।আরএসএফ কতটা শক্তি এবং সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিল, তা প্রকাশ পায়। ২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া যুদ্ধটি সামরিক বাহিনী এবং একটি নতুন মিলিশিয়ার মধ্যে ছিল না, বরং দুটি সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল।উভয়েরই অস্ত্রাগার, আয়ের উৎস, হাজার হাজার সৈন্য এবং বহিরাগত সরবরাহ লাইন ছিল। তার পর থেকে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত; আনুমানিক ১৫০,০০০ মানুষ নিহত এবং তিন কোটির বেশি মানুষ এখন জরুরি মানবিক সহায়তাপ্রার্থী। এই বিস্ময়কর পরিসংখ্যানে এখনও সুদানের ট্র্যাজেডি হলো, দেশটির দ্রুত অবনতি, এর অবকাঠামো ধ্বংস অথবা দারফুরে আরএসএফের অভিযানের বিশেষ নির্মমতার গল্প পুরোপুরি ধরা পড়ে না। এল ফাশার দখলের পর আরএসএফ দেশের পশ্চিমে তার অবস্থান সুসংহত করেছে। ২০২৩ সালে যুদ্ধের প্রথম দিকে রাজধানী খার্তুম দখল করার পর আরএসএফ সেনাবাহিনীর কাছে এটি হারায় এবং দারফুর পুনরুদ্ধারের ওপর তার মনোযোগ নিবদ্ধ করে। সেখানে আরএসএফ অ-আরব জনগোষ্ঠীর ওপর প্রতিশোধ নিতে জাতিগতভাবে তাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। এই বছরের শুরুতে সুদানের বৃহত্তম বাস্তুচ্যুত শিবিরে হামলা চালিয়ে আরএসএফ জাতিগত পরিচয় দেখে শত শত বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে। এল ফাশারের পতনের পর আরও কী অপেক্ষা করছে, তা কল্পনাতীত। যে ভিডিওগুলো প্রকাশিত হচ্ছে তাতে স্থানীয়রা মিলিশিয়াদের কাছে তাদের প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছে। একজনকে গুলি করার আগে একজন কমান্ডার তাকে বলেছিলেন কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না। ‘আমি কখনও তোমাদের প্রতি দয়া করব না।’ কমান্ডার বলেন, ‘আমাদের কাজ কেবল হত্যা করা।’এটি আগেই অনুমিত ছিল। গণহত্যা এবং নৃশংসতার ঝুঁকি সম্পর্কে কয়েক মাস ধরে সতর্কতা জারি করা হচ্ছিল। অন্যান্য সংঘর্ষের স্থান থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত দারফুরি এল ফাশারে জড়ো হয়েছিল। লড়াই তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার ছত্রভঙ্গ হয় বা আটকা পড়ে। এটি এমন একটি দৃশ্য যা কেবল রুয়ান্ডা গণহত্যার প্রথম দিনগুলোই নয়, বরং ২০ বছর আগে দারফুরের গণহত্যার অতীত পর্বগুলোকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। কেবল বলা যায়, এবার তা আরও ঘনীভূত এবং তীব্র। আজকের আরএসএফ অতীতের জানজাউইদ, তবে এবারের যুদ্ধে তারা শক্তিশালী বহিরাগত মিত্রদের সমর্থন পেয়েছে এবং কয়েক দশক ধরে তাদের প্রতি শত্রুতাপূর্ণ অ-আরব জনগোষ্ঠীকে আবারও নির্মূল করার জন্য তাদের নতুন জিঘাংসা রয়েছে। আজ তারা উট বা ঘোড়ায় চড়ে আসেনি, বরং চার চাকার কারিগরি সরঞ্জামে সজ্জিত, মাউন্টেড মেশিনগান এবং শক্তিশালী ড্রোন দিয়ে সজ্জিত বাহনে চড়ে এসেছে। সেই অস্ত্রাগার, সেই সঙ্গে এল ফাশার এবং বৃহত্তর দারফুর অঞ্চলে বিপর্যয়ের স্পন্সর হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। আরব আমিরাত আরএসএফের একটি দৃঢ় ঐতিহাসিক মিত্র আমিরাত আরএসএফের হাতে তহবিল এবং অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং এটি করে সুদানের যুদ্ধের মেয়াদ ও তীব্রতা বাড়িয়েছে। প্রচুর প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের ভূমিকা অস্বীকার করে চলেছে। বিনিময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত সুদানের একটি বৃহৎ,কৌশলগত,সম্পদ-সমৃদ্ধ এলাকায় তার অবস্থান নিশ্চিত এবং ইতোমধ্যে আরএসএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় খনন করা বেশির ভাগ সোনা দখল করেছে। সুদানের যুদ্ধকে বিস্মৃত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাস্তবে তা সহ্য এবং উপেক্ষা করা হচ্ছে। কারণ সুদানের ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করা মানে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির নরকসম গহ্বরের দিকে তাকানো। এর অর্থ আফ্রিকা এবং তার বাইরে কিছু উপসাগরীয় শক্তির ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা দেখার সঙ্গে এই সত্যটিও স্বীকার করা গণহত্যাকারী মিলিশিয়াকে সমর্থন করা বন্ধ করা এবং বিরত থাকার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ এই শক্তিগুলোর ওপর কোনো অর্থবহ চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে না। কারণ যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যরা রাষ্ট্রগুলোর ঘনিষ্ঠ মিত্র। যুক্তরাজ্যের সরকারি কর্মকর্তারা আফ্রিকান কূটনীতিকদের সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমালোচনা চেপে যেতে বলেছেন। গত সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছিল, আরএসএফ ব্যবহৃত ব্রিটিশ সামরিক সরঞ্জাম সুদানের যুদ্ধক্ষেত্রে পাওয়া গেছে। সুদানের দুটি সামরিক দল একে অপরকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে পারে না। বিশ্বব্যাপী, যে পররাষ্ট্রনীতি একসময় কূটনৈতিক বাস্তববাদ এবং নৈতিক চাপের কাছে নমনীয় দলগুলোর মিশ্রণের ফলাফল ছিল, তা এখন শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ অনুসরণের নগ্ন অনুশীলনে পরিণত হয়েছে, তারা যেভাবেই তা উপযুক্ত মনে করুক না কেন। এল ফাশার এবং বৃহত্তর দারফুর অঞ্চলে যা ঘটছে তার মাত্রা এবং স্পষ্টতা মহাকাশ থেকে দৃশ্যমান অপরাধ-অজ্ঞতার ভান করার কোনো সুযোগ দেয় না। এটি আমরা আগে যা দেখেছি তার পুনরাবৃত্তি এবং এমন একটি যুদ্ধের নতুন অধ্যায়, যা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে যাতে সবাই জানতে পারে কী ঘটছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সেই সঙ্গে আরএসএফের ওপর যাদের প্রভাব আছে, কিন্তু জরুরি পদক্ষেপ বা চাপ ছাড়াই সেখানে সহিংসতা চলতে দিচ্ছে, তাদের হাতেও রক্তের দাগ লেগে আছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রতীকী স্বীকৃতিও একদিন বাস্তব স্বাধীনতার ভিত্তি গড়ে তোলে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম প্রথমে প্রতীকী নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপ দিয়েই শুরু হয়েছিল, যা শেষপর্যন্ত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে। একইভাবে ফিলিস্তিন প্রশ্নে আজকের প্রতীকী স্বীকৃতি ভবিষ্যতের পূর্ণ স্বাধীনতার বীজ বপন করছে, বলা যায়। আজকের এ পথ ধরেই একদিন বিশে^র রাজনৈতিক মানচিত্রে ভাস্বর হবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সদিচ্ছার ওপর। যুক্তরাষ্ট্র যদি তার ভেটো রাজনীতি চালিয়ে যায়, তবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আরও বিলম্বিত হবে। কিন্তু যদি বৈশ্বিক জনমতের চাপ, পশ্চিমা দেশের নতুন স্বীকৃতি ও আরববিশ্বের অভ্যন্তরীণ জনচাপ একসঙ্গে কাজ করে, তবে একদিন ফিলিস্তিন শুধু কাগজে নয়, বাস্তবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন আজকের এই স্বীকৃতিগুলোই হয়ে উঠবে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো দৃষ্টান্ত। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |