দুর্যোগ প্রতিরোধে চাই সমন্বিত উদ্যোগ
বিলকিস নাহার পিংকি
|
মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক কারণে সংঘটিত দূর্ঘটনাকে বলা হয় দুর্যোগ।দুর্যোগ সাধারণত এই ২ প্রকারের হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যও মানুষের খামখেয়ালিপনা অনেকটাই দায়ী। ভূমিকম্প,ব্জ্রপাত,নদী ভাঙন,অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি,বন্যা,সুনামি,টর্নেডো এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও বর্তমানে মানবসৃষ্ট হরতাল,অবরোধ,ভবন ধস,অগ্নিকান্ড,যুদ্ধ-বিগ্রহ সহ বনাঞ্চল নিধনের মতো ভয়াবহ অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের দুর্ভোগের সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন আতঙ্ক। ব্যাহত হচ্ছে সাধারণ জীবনযাত্রা,বিলীন হচ্ছে জনবসতি,বাড়ছে অতিমৃত্যুহার,আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার চরম ক্ষতি হচ্ছে সর্বোপরি থমকে যাচ্ছে মানসভ্যতার অগ্রগতি। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে উন্নয়নশীল দেশে ৯৫% এর অধিক মৃত্যু সংঘটিত হয় দুর্যোগের কারণে। আর শিল্পোন্নত দেশের জিডিপির প্রায় ২০ গুণের বেশি ক্ষতি হয় উন্নয়নশীল দেশে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ হলো ভূমিকম্প। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ বার ভূমিকম্প সংঘটিত হয় যার মধ্যে ৫০০ টি মারাত্মক আকার ধারণ করে। আর প্রতিবছর ভূমিকম্পে মারা যায় প্রায় ১৪ হাজার মানুষ। উল্লেখযোগ্য কিছু ভূমিকম্প এবং এর ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে কতটা ভয়াবহ হতে পারে ভূমিকম্পের পরিণাম। ৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাইজেনটাইনে ভূমিকম্পের ফলে ২৫০,০০০ মানুষ প্রাণ হারান। ১১৩৮ সালের ১১ অক্টোবর সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে সংঘটিত ভূমিকম্পে মারা যায় প্রায় ২৩০,০০০ জন। ১৯৭৬ সালের ১৮ জুলাই চীনের শিল্পোন্নত শহর থাংশানে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ২৪০,০০০ মানুষ মারা যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় শহরের ১ মিলিয়ন মানুষ। এ সময় শহরের ৮৫% বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়,আর শিল্পোন্নত শহর হওয়ায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল বর্ণনাতীত। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর পশ্চিম সুমাত্রা ও ইন্দোনেশিয়ায় ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামি তে প্রায় ২২০,০০০ মানুষ মারা যায় এবং ২ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুহারা হয়। এ সময় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়াও ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি হাইতিতে সংঘটিত ভূমিকম্পে প্রায় ১৫৯,০০০ মানুষ মারা যায় এবং ৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব পরিসসংখ্যান দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভূমিকম্পের তান্ডবলীলা কতটা ভয়াবহ হতে পারে। ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলেও ক্ষেত্রবিশেষে তা ৮-১০ মিনিটও হতে পারে।ভূমিকম্প এক নিমিষেই যে হতাহত এবং ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করে তা অন্যান্য দুর্যোগের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কয়েকগুণ বেশি। ভূমিকম্পের ফলে বহুতল ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা হয় সম্পূর্ণ ধ্বসে যায় বা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন, জরুরি চিকিৎসা সেবা সহ সমস্ত পরিষেবা আংশিক বা সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়।অনেক সময় মহাসড়ক সেতু ও রেলসেতু বিধ্বস্ত বা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া সমুদ্রতলে সৃষ্ট ভূমিকম্পের ফলে সুনামির মতো ভয়াবহ দুর্যোগ সংঘটিত হয়। এতে করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট ভূমিকম্প যে শুধু প্রাকৃতিক কারণে সংঘটিত হয় তা কিন্তু নয় মানবসৃষ্ট অনেক কারণ ভূমিকম্পের জন্য দায়ী যার মধ্যে অন্যতম হলো পারমাণবিক বিস্ফোরণ,মাইন বা খনি খনন,কৃত্রিম জলাধার বা বাধ ধস ইত্যাদি। মানবসৃষ্ট এসব ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে ৭.৯ পর্যন্ত হতে পারে। বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগের আরেকটি অন্যতম উদাহরণ হলো ঘূর্ণিঝড়। অঞ্চলভেদে এর নামকরণে দেখা যায় ভিন্নতা। বিভিন্ন অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়কে টর্নেডো,টাইফুন,হ্যারিকেন,তাইফু,ব্যগুই,সাইক্লোন ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। শক্তিশালী কিছু ঘূর্ণিঝড় এবং তাদের বিধ্বংসী রুপের কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো-২৫ নভেম্বর ১৮৩৯ সাল,বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্ট সাইক্লোনে প্রায় ২০,০০০ টি জাহাজ এবং নৌযান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রাণহানি ঘটে ৩০০,০০০ মানুষের।১৮৮১ সালে ভিয়েতনামে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়েও মারা যায় প্রায় ৩০০,০০০ মানুষ। ১৯৭০ সালের ১২-১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে শক্তিশালী টাইফুন আঘাত হানে যা ছিল ৪ টি বিশাল হ্যারিকেনের সমশক্তিসম্পন্ন। এতে করে প্রায় ৩০০,০০০-৫০০,০০০ মানুষ মারা যায় এবং এর ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৮৬ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ২০০৮ সালে মায়ানমারে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের তান্ডবে প্রায় ১৪০,০০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এসব ঘূর্ণিঝড়ে গবাদিপশু,বসতভিটা,গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সহ জরুরি সেবা সমূহ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিবৃষ্টি,অতিরিক্ত বরফ গলা পানি কিংবা অন্যান্য কারণে সৃষ্টি হওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যাতেও প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটছে এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ব। ১৯৯৮-২০১৭ সাল অবধি ২ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে। অতিবৃষ্টির কারণে চীনে ১৮৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে বন্যায় প্রায় ৫০০০ বর্গ মাইল এলাকা প্লাবিত হয় এতে ৯০০,০০০ থেকে ২ মিলয়ন মানুষ প্রাণ হারায়। ১৯৩১ সালে চীনে ৭০,০০০ বর্গ মাইল প্লাবিত হয় এবং এতে সরকারি হিসেব মতে ২ মিলিয়ন এবং NOAA এজেন্সির মতে প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বন্যাকালীন এবং বন্যা-পরবর্তী সময়ে বাসস্থান সংকট,সুপেয় পানির এবং খাদ্যের তীব্র অভাব,সকল পরিষেবা আংশিক বা পরিপূর্ণ রুপে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া(জরুরি চিকিৎসা সেবা সহ) এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার কারণে বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে ডায়রিয়া,আমাশয় সহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ ও খাদ্যাভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র দাবদাহ এবং খরার কারণে যে হারে দাবানলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে নিঃসন্দেহে নতুন করে আতংক সৃষ্টি করেছে।সম্প্রতি ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ দাবানলের শিকার হয়। ১৮ বছরে এমন ভয়াবহ দাবানল বিশ্ব দেখেনি বলে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন।এতে প্রায় ৩৪৩ মেগাটন কার্বন নিঃসৃত হয়েছে যা প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়া,তুরস্ক,গ্রিস,ফ্রান্স,ইতালি,আলজেরিয়ার মতো দেশে সম্প্রতি যে পরিমাণে দাবানল হয়েছে তা পরিবেশের সুরক্ষা এমনকি মানবসভ্যতার জন্য চ্যালেঞ্জিং-ও বটে। তাছাড়া অপরিকল্পিত নদী খনন,অনিয়ন্ত্রিত নিষ্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদির কারণে নদীভাঙনের মত দুর্ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছে নদীভাঙনের কারণে। আর বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫৭ লাখ যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এছাড়াও আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত,খরা সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিনিয়ত ব্যাপক আর্থ-সামাজিক এবং আবকাঠামোগত ক্ষতিসাধিত হচ্ছে সেইসাথে অসংখ্য প্রাণহানি তো ঘটছেই। প্রাকৃতিক এসকল দুর্যোগ ছাড়াও মানবসৃষ্ট দাঙ্গা,হরতাল-অবরোধ,যুদ্ধ-বিগ্রহ,বনায়ন ধ্বংস,অপরিকল্পিত নগরায়ন,ভবন ধস সহ আরো অসংখ্য অপ্রত্যাশিত ঘটনা দুর্যোগের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা ক্ষমতার লোভে বা কোন ঘটনাকে ইস্যু করে যে অবরোধ এবং দাঙ্গার সৃষ্টি হয় তাতে একদিকে যেমন জনসাধারণের ভোগান্তি বাড়ে তেমনি স্থবির হয়ে পড়ে সেদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন। অনেক সময় দাঙ্গায় প্রানহানির ঘটনাও ঘটে। এসব দাঙ্গা ছড়াতে পারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।মানবসৃষ্ট অন্যতম উল্লেখযোগ্য অপ্রত্যাশিত ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে তার ভয়াবহতা কতটা মারাত্মক ছিল। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল অবধি চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সর্বমোট ৪০ কোটি মানুষ হতাহত হয়। এ যুদ্ধে ৭০ টি দেশ জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ এবং গৃহহীন হয় প্রায় ১ কোটি মানুষ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ছিলো আরো বেশি।১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধকে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে সামরিক বেসামরিক মিলে দুই পক্ষের প্রায় ৭ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শুধুমাত্র ১৯৪৫ সালেই মোট ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এ দুটি বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতি,রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।থমকে যায় বিশ্বের অগ্রগতি,মানবসভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তাছাড়া হিরোশিমা-নাগাসাকি তে ফেলা পারমাণবিক বোমার ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগ ও দুর্যোগের পর্যায়ে পড়ে। যার ফলে মারা যায় ১২৯,০০০–২৪৬,০০০ এর বেশি মানুষ। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা,জনবসতি বিলীন হয়ে যায়।এর ভয়াবহতার রেশ কাটেনি এখনো;জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু। তাছাড়া ভবন ধস কিংবা অগ্নিকান্ডের মতো ঘটনায় আমাদের দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু সহ গুরুত্বপূর্ণ কল-কারখানা কিংবা স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের দেশে রানা প্লাজা ধসের মতো ঘটনা কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে মালিবাগের অগ্নিকাণ্ড বা সেজান গ্রুপ এবং গাজীপুরের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাড়া দিয়েছে পুরো বিশ্বকে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই প্রভাবশালী কারখানা মালিকেরা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অগ্নিসংযোগ করে থাকে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। এছাড়াও বনাঞ্চল ধ্বংস কিংবা অপরিকল্পিত নগরায়নের মতো অপরিনামদর্শীতার ফলে যে অসংখ্য নিত্যনতুন দুর্যোগের শিকার হবে বিশ্ব তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২৫ শতাংশ থাকা দরকার বনাঞ্চল নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে অধিকাংশ দেশেই অনুপস্থিত। মানবসৃষ্ট দুর্যোগের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটনের পিছনেও মানুষের খামখেয়ালিপনা এবং অদূরদর্শীতা ভীষণভাবে দায়ী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয় প্রধানত ৪ টি কারণে -ভৌগলিক অবস্থান,নদীনালা,ভূমির গঠন এবং জলবায়ুর কারণে। আর প্রতিনিয়ত নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা,অপরিকল্পিত খনন এবং অনিয়ন্ত্রিত নিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে নদীনালা সংক্রান্ত দুর্যোগ সমূহ যেমন-নদীভাঙন,বন্যা ইত্যাদির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম কারণ হচ্ছে জলবায়ু। আর বর্তমানে বিশ্বায়নের ফলে উল্লেখযোগ্য হারে জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটেছে তার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে,দাবানলে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে,মানুষ এবং প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়ছে সর্বোপরি বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে পৃথিবী। ক্রমাগত শিল্পকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে মিশছে,অপরিশোধিত বর্জ্য ও তেল পানিতে ফেলা হচ্ছে,ময়লা-আবর্জনা অপরিকল্পিত ভাবে যেখানে সেখানে ফেলে দূষিত করা হচ্ছে মাটি। কার্বন নিঃসরণ,ক্লোরোফ্লোরো কার্বন,মিথেন,কার্বোনিল,কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি সহ ক্ষতিকর গ্যাস সমূহ বাতাসে মিশে বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর কে করছে ক্ষতিগ্রস্ত। উল্লেখ্য ওজোনস্তর সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মিসহ ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে।যেসব রশ্মির প্রভাবে চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং ত্বকে বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার হতে পারে। কিন্তু ওজোনস্তর এর পুরুত্ব কমে যাচ্ছে ৪ শতাংশ হারে।প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এন্টার্কটিকা এবং আর্কটিকের বরফাঞ্চল গলে যাচ্ছে এতে করে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা,প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা এবং গৃহহীন হয়ে পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০২০ সালে ঝড়,বন্যা,দাবানল ও খরার কারণে ৩ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে আর যুদ্ধ ও সহিংসতায় ১ কোটি মানুষ গৃহহীন হয়েছে।অর্থাৎ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট এসব দুর্যোগ মিলিয়ে প্রায় ৪ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে যা চলতি বছরে ৫ কোটিতে দাঁড়াবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। এছাড়াও নতুন নতুন অঞ্চলে বরফ গলার কারণে বরফের নিচে চাপা পড়া দীর্ঘদিন ধরে থাকা অসংখ্য ক্ষতিকারক অণুজীব বের হয়ে আসছে এবং পানির স্রোতের মাধ্যমে মিশে যাচ্ছে মহাসাগর-সাগর থেকে নদ-নদীতে।বেরিয়ে আসছে পার্মাফ্রস্ট,ক্ষতিকারক এসব অণুজীবের ফলে হয়তো ভবিষ্যতে দেখা দিতে পারে করোনার মতো নতুন কোন মহামারি। বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে একদিকে যেমন অক্সিজেনের ঘাটতি হচ্ছে,ওজোনস্তরের ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে ঔষধি বিভিন্ন গাছ-গাছালিও হারিয়ে যাচ্ছে যেসব মেডিসিন হয়তো ল্যাবে বা বাণিজ্যিকভাবে তৈরী করা খুবই কঠিন এবং ব্যয়বহুল। ঔষধি গাছ ছাড়াও বিভিন্ন প্রাণী থেকে প্রাপ্ত (যেমন সাপ) মহামূল্যবান টক্সিন যা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেসব প্রাণীও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দুর্যোগ সেটা হোক প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট তার পরিণাম যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা কিছুটা হলেও উপরের পরিসংখ্যান দেখে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে। মানবসভ্যতার অগ্রগতি তে এসকল দুর্যোগ অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।তাই সম্মিলিতভাবে এসব দুর্যোগ প্রতিহত করা একান্ত কর্তব্য। এক্ষেত্রে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ যার অধিকাংশই প্রাকৃতিক কারণে সংঘটিত হয় এবং এর পূর্বাভাস সম্পর্কে জানার কোন উপায় নেই তাই এসব দুর্যোগ প্রতিরোধ একপ্রকার অসম্ভব হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এসবের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ লাঘব করা সম্ভবপর হবে।এক্ষেত্রে দুর্যোগ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে প্রয়োজনীয় সতর্কতা এবং সচেতনতা তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর যেসব ক্ষেত্রে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব যেমন-ঘূর্ণিঝড়,বন্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে খাদ্য মজুদ,নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।তাছাড়া দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে আক্রান্ত এলাকায় দেখা দিতে পারে তীব্র খাদ্যসঙ্কট;সৃষ্টি হতে পারে মহামারী। এসব ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্ক থাকা উচিৎ এবং খাদ্য,চিকিৎসা সরঞ্জাম সহ প্রয়োজনীয় সব কিছু আগে থেকেই মজুদ রাখা দরকার।দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী জনবল গঠন করে তাদের ডাটাবেজ তৈরি করা দরকার।দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে দ্রুত অবকাঠামোগত স্থাপনা সমূহ পুননির্মাণ সহ দুর্যোগকালীন সময়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির জন্য বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করা দরকার।প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ মোকাবেলায় রাষ্ট্রের উচিৎ সুষ্ঠু নিয়ম-নীতির পাশাপাশি সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করা।আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর প্রতি আমরা যতটুকু সচেতন মানবসৃষ্ট দুর্যোগের প্রতি বোধহয় ঠিক ততটা সচেতন নই।অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি সহ অবৈধভাবে নির্মিত ভবনসমূহ উচ্ছেদ করতে হবে।দাঙ্গা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়াতে বিভিন্ন শান্তি-চুক্তি বিকল্প হতে পারে।জলবায়ু ও উষ্ণায়নের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে অবগত করতে হবে সেই সাথে পরিবেশ রক্ষায় কিভাবে সবাই মিলেমিশে কাজ করা যায় সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে।প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর পাশাপাশি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ সমূহকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সবধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।তাতে করে হ্রাস পাবে দুর্যোগে মৃত্যুহার,শক্তিশালী হবে বিশ্ব-অর্থনীতির চাকা,সুন্দর হবে পৃথিবী সর্বোপরি পরবর্তী প্রজন্ম পাবে সুন্দর ভবিষ্যৎ। লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ডেল্টা টাইমস্/বিলকিস নাহার পিংকি/সিআর/আরকে |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |