|
নগর সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যের বিলুপ্তি
আরমীন আমীন ঐশী
|
![]() নগর সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যের বিলুপ্তি নতুন প্রজন্ম জানে আইফোনের সর্বশেষ মডেল, কিন্তু জানে না ‘শীতলক্ষ্যা’ নামটির অর্থ কী। উন্নতি হয়েছে অনেক, কিন্তু চারপাশের গল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি নতুন ভবন দাঁড়াচ্ছে, আর প্রতিটি স্মৃতি নিঃশব্দে ধ্বংস হচ্ছে। এই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির নামই ঐতিহ্য। ঐতিহ্য কেবল পুরোনো পোশাক বা স্থাপনার নাম নয়—এটি এক জাতির আত্মপরিচয়, এক শহরের প্রাণের ভাষা। কোনো দেশের উন্নতি তখনই অর্থবহ হয়, যখন আধুনিকতা তার শিকড় ভুলে যায় না। কিন্তু আজকের নগরজীবন যেন উল্টো পথে হাঁটছে। একসময় মসজিদের শহর, রন্ধনের শহর, কবির শহর ছিল ঢাকা। মোগল আমলের স্থাপত্য, নবাবদের ঐশ্বর্য, ঘরোয়া সংস্কৃতি—সবই ছিল এই শহরের অহংকার। অথচ আজ ঐতিহ্য টিকে আছে কেবল দেয়ালের চিত্র, পোস্টার, বা বইয়ের পাতায়। আধুনিকতার ঝড়ে পুরান ঢাকার গলির সৌন্দর্য, পাড়ার আড্ডা, মেলা, গানের আসর—সব হারিয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতি আজ সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ড, ঐতিহ্য ইতিহাস বইয়ের অধ্যায়। পুরনো দোতলা বাড়িগুলোর দেয়ালে যে শত বছরের ইতিহাস লেগে ছিল, সেগুলো একে একে ভেঙে জায়গা নিচ্ছে চকচকে কাচের অ্যাপার্টমেন্ট। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার প্রায় ৭০% তরুণ এখন বিদেশি উৎসব—ভ্যালেন্টাইনস ডে, হ্যালোইন, নিউ ইয়ারে বেশি আগ্রহী। বরং পহেলা বৈশাখ তাদের কাছে এখন শুধু ছবি তোলা ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দেওয়ার উপলক্ষ। যে মাঠে একসময় হাডুডু, কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা আর ঘুড়ি ওড়ানো হতো, সেই মাঠ এখন গাড়ি পার্কিংয়ে পরিণত। শিশুরা জানে বিদেশি কার্টুন চরিত্র, কিন্তু জানে না নবান্নের স্বাদ বা গ্রামের মেলার রূপ। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার—বোরহানি, নেহারী, মোরগ পোলাও—এখন ব্র্যান্ডেড রেস্টুরেন্টের দামি মেন্যু; ঐতিহ্য এখন সংস্কৃতি নয়, বাণিজ্যের পণ্য। ঐতিহ্য বিলুপ্তির পেছনে রয়েছে নানা বাস্তব ও মানসিক কারণ। শহর বাড়ছে, মানুষ বাড়ছে, কিন্তু জায়গা কমছে। নতুন ফ্ল্যাট, নতুন সড়ক, নতুন ব্যবসা—সব কিছুর মাঝে জায়গা পাচ্ছে না পুরনো স্মৃতি। ঐতিহাসিক ভবন ভেঙে উঠছে শপিং মল। উৎসব মানে স্পনসরশিপ, মেলা মানে মার্কেটিং। অনুভূতি আজ বিজ্ঞাপনের রঙে ঢাকা। পরিবারে আর সময় নেই—বাবা-মা ব্যস্ত, সন্তান ব্যস্ত; গল্প, গান, ইতিহাস শেখানোর পরিবেশ হারিয়ে গেছে। ফেসবুক ও টিকটক হয়ে উঠেছে নতুন সংস্কৃতি। ঐতিহ্য এখন কন্টেন্ট—মূল্যায়ন হয় লাইক, শেয়ার, কমেন্টে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও দুর্বল। অনেক ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হচ্ছে। স্থাপত্য সংরক্ষণের আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই বললেই চলে। বৈশ্বিকতার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা হারাচ্ছি নিজস্ব রং, খাদ্য, পোশাক, সুর, ভাষা—ফিউশন সংস্কৃতির নামে মুছে যাচ্ছে মৌলিক পরিচয়। ঐতিহ্য বাঁচানো মানে পুরোনোতে আটকে থাকা নয়—বরং শিকড়কে নতুনভাবে জীবিত রাখা। পুরান ঢাকার স্থাপত্য, প্রাচীন মসজিদ, পুরনো বাড়ি সংরক্ষণে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের উদ্যোগ জরুরি। স্কুলে শিশুদের নিজেদের ইতিহাস, লোকসংগীত, গল্প, সংস্কৃতি শেখানো প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিকড়হীন না হয়। মিডিয়াকে স্থানীয় সংগীত, নাটক, খাবার ও উৎসব তুলে ধরতে হবে। পরিবারে ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালন, ভাষার যত্ন, স্থানীয় পণ্যের ব্যবহার—ছোট পদক্ষেপ হলেও বড় পরিবর্তন আনতে পারে। নগর পরিকল্পনায় ঐতিহাসিক অঞ্চলগুলোকে সংরক্ষণযোগ্য এলাকা হিসেবে ঘোষণা জরুরি—উন্নয়নের নামে ইতিহাস ধ্বংস করা চলবে না। নগরায়ণ থামানো যাবে না, কিন্তু ঐতিহ্যের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। শহর বড় হতে পারে—কিন্তু শহরের আত্মা ছোট হয়ে গেলে উন্নতি অর্থহীন। আলোর ঝলকানি যতই বাড়ুক, যদি সেই আলো আমাদের ইতিহাসের ছায়া ঢেকে দেয়, তবে তা অগ্রগতি নয়—নিঃসঙ্গতা। শহরের সৌন্দর্য কেবল তার ভবনে নয়, তার স্মৃতিতে। ঐতিহ্য শহরের আত্মা—আর সেই আত্মা রক্ষার দায় আমাদেরই। ঐতিহ্য এমন এক সোনালি নকশা, যা মুছে গেলে শহর শুধু কংক্রিট আর ধোঁয়ার স্তূপ হয়ে যাবে। আমাদের শহর যেন আবার পাখির ডাক শুনে জাগে; নববর্ষের সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রার রঙে ভরে ওঠে; পুরান ঢাকার ছাদে আবার ঘুড়ি ওড়ে—এই স্বপ্নটুকু ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। এখনই ভাবতে না পারলে, একদিন হয়ত আমাদের সন্তান বলবে—“ঢাকা? ওটা একসময় সুন্দর ছিল।” শহর যেন ইতিহাস না হয়ে যায়—এই দায় সবার। লেখক: গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ডেল্টা টাইমস্/আরমীন আমীন ঐশী/আইইউ |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |