মেধা হারাচ্ছে বাংলাদেশ : কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার!
সাদিয়া সুলতানা রিমি
প্রকাশ: রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৫, ৪:০৬ পিএম

মেধা হারাচ্ছে বাংলাদেশ : কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার!

মেধা হারাচ্ছে বাংলাদেশ : কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার!

বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আজ ক্রমশ বিদেশমুখী হচ্ছে। একসময় বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ মানে ছিল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশে ফিরে কাজ করা, কিন্তু এখন সেটি পরিণত হয়েছে স্থায়ীভাবে প্রবাসে চলে যাওয়ার প্রবণতায়। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য তরুণরা বিদেশে পড়াশোনা শেষে আর ফিরে আসছে না। তারা থেকে যাচ্ছে উন্নত সুযোগ-সুবিধার দেশে। এ যেন এক নীরব মেধা-পলায়ন, যা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও সম্ভাবনাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করছে।

মেধা হারানোর এই প্রবণতার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, দেশে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ এখনো সীমিত। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ল্যাব, গবেষণা তহবিল এবং আন্তর্জাতিক মানের একাডেমিক পরিবেশের অভাব রয়েছে। যে তরুণরা গবেষণা বা উদ্ভাবনে আগ্রহী, তারা উন্নত পরিকাঠামো ও স্বাধীন চিন্তার পরিবেশের খোঁজে বিদেশে চলে যায়। দ্বিতীয়ত, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগও সীমিত। অনেক সময় যোগ্যতার সঙ্গে বেতনের সামঞ্জস্য থাকে না, আবার প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে তরুণরা প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তারা এমন দেশে যেতে চায়, যেখানে যোগ্যতার মূল্যায়ন হয় এবং শ্রমের যথাযথ প্রতিদান মেলে।

এর পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আইনের দুর্বল শাসন ও সামাজিক অনিরাপত্তাও মেধাবীদের নিরুৎসাহিত করছে। একজন তরুণ যখন দেখে যে পরিশ্রম বা দক্ষতার চেয়ে দলীয় পরিচয় বা সম্পর্কই সাফল্যের পথ, তখন তার মনে দেশে থাকার আগ্রহ কমে যায়। তা ছাড়া উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবেশ ও জীবনের মান তুলনামূলক ভালো যা পরিবার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অধিক নিরাপদ বলে মনে হয়। তাই অনেকে নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেও বিদেশে স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই মেধা-পলায়নের প্রভাব জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীরভাবে পড়ছে। প্রশাসন, শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যারা বিদেশে থেকে সফলভাবে কাজ করছে, তাদের উদ্ভাবনী শক্তি, নেতৃত্ব ও উদ্যোগী মনোভাব দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারছে না। ফলে দেশ এক ধরনের “innovation gap”-এর মুখোমুখি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য শিক্ষক ও গবেষকের অভাব শিক্ষার মানকে আরও নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। একইসঙ্গে যারা দেশে থেকে সংগ্রাম করছে, তারা দেখছে যে এখানে যোগ্যতার চেয়ে সম্পর্ক ও তোষণই বেশি গুরুত্ব পায়। এতে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতি বাড়ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যেও দেশপ্রেম ও আত্মবিশ্বাস ক্ষয়ে দিচ্ছে।
    
তবে এখনই যদি বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া যায়, এই প্রবণতাকে অনেকটা রোধ করা সম্ভব। প্রথমেই প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে এবং গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল ও প্রযুক্তিগত সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে কর্মসংস্থানের পরিধি বাড়াতে হবে, বেসরকারি ও সরকারি খাতে মেধা অনুযায়ী বেতন কাঠামো ও পদোন্নতির স্বচ্ছ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে তরুণরা নিজেদের যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন দেখতে পাবে, যা তাদের দেশে রাখার অনুপ্রেরণা জোগাবে।

এ ছাড়া বিদেশে থাকা মেধাবীদের দেশে ফেরার জন্যও কার্যকর নীতি নেওয়া যেতে পারে। যারা বিদেশে পড়াশোনা বা কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তাদের গবেষণা, নীতিনির্ধারণ বা শিক্ষা খাতে যুক্ত করার সুযোগ দিতে হবে। অনেক দেশ “Reverse Brain Drain” নীতি গ্রহণ করে সফল হয়েছে বাংলাদেশও তা অনুসরণ করতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, একটি দেশের আসল সম্পদ হলো তার মানুষ, বিশেষ করে মেধাবী মানুষ। যদি সেই মেধা অন্য দেশে চলে যায়, তাহলে উন্নয়নের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে সেই মেধা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন সুযোগ, সুশাসন ও সম্মান। তরুণদের এমন পরিবেশ দিতে হবে, যেখানে তারা বিশ্বাস করবে যে এখানেই তাদের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। কারণ, উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হবে তখনই, যখন দেশের মেধা, শ্রম ও ভালোবাসা এই মাটিতেই বিকশিত হবে।


লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


ডেল্টা টাইমস্/সাদিয়া সুলতানা রিমি/আইইউ

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com