|
জুলাই সনদ ও নোট অব ডিসেন্টের রাজনীতি, ঐকমত্যের আড়ালে নতুন বিভাজনের আশঙ্কা
রাফায়েল আহমেদ শামীম:
|
![]() জুলাই সনদ ও নোট অব ডিসেন্টের রাজনীতি, ঐকমত্যের আড়ালে নতুন বিভাজনের আশঙ্কা বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সবসময়ই “উপরমুখী কাঠামো” থেকে নিচে নেমে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক অতীত পর্যন্ত- আমরা দেখেছি, সাধারণ মানুষের পরিশ্রম, ত্যাগ ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র টিকে থাকে; কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সর্বদাই একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে। জুলাই সনদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। যদিও সনদটি তাত্ত্বিকভাবে সুশাসন, জবাবদিহি ও সংস্কারের কথা বলেছে, কিন্তু তার প্রয়োগের প্রক্রিয়া এতটাই “গণবিচ্ছিন্ন” যে, জনগণ এর মধ্যে নিজেদের প্রতিফলন দেখতে পায়নি। ফলে এই সনদটি আজ দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে- একটি হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে স্বস্তি, কারণ তারা মনে করে একটি কাঠামো তৈরি হয়েছে; অন্যটি হলো জনগণের মধ্যে এক গভীর সংশয়, কারণ তারা মনে করছে, এই কাঠামোর মধ্যে তাদের স্থান নেই। গণতন্ত্র তখনই অর্থবহ হয়, যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু জুলাই সনদ সেই অংশগ্রহণকে প্রায় উপেক্ষা করেছে। এখানে একটি বড় প্রশ্ন থেকে যায়- কেন এই গণবিচ্ছিন্ন সংস্কারনীতি বারবার ফিরে আসে? কারণ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখনো পর্যন্ত দলীয় রাজনীতি একটি “প্যাট্রন–ক্লায়েন্ট” সম্পর্কের মধ্যেই আবদ্ধ। এখানে রাজনৈতিক আনুগত্যই মূল সম্পদ, আদর্শ নয়; এখানে দলই রাষ্ট্র, নেতা মানেই আইন। এই সংস্কৃতির মধ্যে দাঁড়িয়ে যে কোনো সুশাসনমুখী দলিল যতই সুন্দর হোক না কেন, তা জনগণের কাছে পৌঁছাবে না। জুলাই সনদও সেই বাস্তবতার ফাঁদে আটকা পড়েছে। এই সনদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা হলো, এটি রাজনৈতিক ঐকমত্যের কথা বললেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে নীরব। একটি রাষ্ট্রের সংস্কার তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও ন্যায্যতা আনে। কিন্তু জুলাই সনদের মূল গুরুত্ব ছিল সাংবিধানিক কাঠামো, ক্ষমতার ভারসাম্য ও নির্বাচনী ব্যবস্থা ঘিরে। জনগণের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্নগুলো সেখানে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ এই সনদে নিজেদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন দেখতে পায়নি। অন্যদিকে, বিএনপির “নোট অব ডিসেন্ট” বা ভিন্নমতের দলিল পুরো প্রক্রিয়াটিকে নতুন এক রাজনৈতিক মাত্রা দিয়েছে। তারা অভিযোগ তুলেছে- জুলাই সনদ কেবল সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করছে, বিরোধী পক্ষের মতামত যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এই আপত্তি অনেকের কাছে রাজনৈতিক কৌশল মনে হলেও, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভিন্নমত প্রকাশই তো গণতন্ত্রের প্রাণ। যদি সবাই একসাথে হাততালি দেয় অথচ অন্তরে দ্বিধা লুকায়, তাহলে সেই ঐকমত্য কাগজে-কলমে টেকে, বাস্তবে নয়। এখানেই “নোট অব ডিসেন্ট” বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার সূচনা করেছে। কারণ, আপত্তি জানানো মানে ঐকমত্যের বিরোধিতা নয়; বরং তা একটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার স্বীকৃতি দেয়। এই আপত্তির মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতের সংসদীয় ব্যবস্থায় জনগণ নতুন করে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। আমরা যদি মনে করি, ঐকমত্য মানে নীরব সম্মতি, তাহলে গণতন্ত্রের মূল আত্মাকেই অস্বীকার করা হয়। বরং সত্যিকারের ঐকমত্য মানে হলো তর্ক, বিতর্ক ও ভিন্নমতের মধ্য দিয়ে সমাধানে পৌঁছানো। জুলাই সনদ প্রণেতারা হয়তো চেয়েছিলেন একটি দ্রুত সমাধান, কিন্তু গণতন্ত্রে “দ্রুত সমাধান” বলে কিছু নেই। এখানে সময় লাগে, আলোচনা লাগে, জনগণের ধৈর্য ও অংশগ্রহণ লাগে। গণতন্ত্র মানে কোনো রূপকল্প নয়, বরং একটি চলমান প্রক্রিয়া- যেখানে ভিন্নমতেরও জায়গা থাকে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি আশার দিক হলোÑএই বিতর্কের মধ্য দিয়েই অংশগ্রহণের পরিধি বাড়ছে। ঐকমত্য কমিশনের মতো উদ্যোগগুলো অন্তত দেখিয়েছে যে, ভিন্নমতের রাজনীতিও এখন স্বীকৃতি পাচ্ছে। বিএনপির আপত্তি বা “নোট অব ডিসেন্ট” যদি সংসদীয় আলোচনায় আসে, জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিতর্ক হয়, তাহলে সেটিই হবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চা। তবে আশঙ্কা এখানেই- এই বিতর্ককে যদি আমরা পরিণত করি আরেকটি বিভাজনে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও পুরোনো দ্বন্দ্বে ফিরে যাবে। আমরা ভুলে যেতে পারি না, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের দেখিয়েছে- জনগণকে দীর্ঘদিন উপেক্ষা করলে তারা নিজেই পরিবর্তনের দাবিতে রাস্তায় নামে। সেই অভিজ্ঞতা এখনো তাজা, এবং তার পুনরাবৃত্তি কেউ চায় না। তাই জুলাই সনদের বাস্তবায়ন শুধু একটি প্রশাসনিক বা সাংবিধানিক ইস্যু নয়, এটি আসলে একটি রাজনৈতিক চেতনার প্রশ্ন। জনগণকে সঙ্গে না নিয়ে কোনো সংস্কার সফল হয় না। যে দেশটির রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে পরিবারকেন্দ্রিক নেতৃত্ব, দলীয় আনুগত্য, দুর্নীতি ও পৃষ্ঠপোষক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত- সেই দেশ যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চায়, তাহলে আগে তাকে শিখতে হবে কিভাবে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রে আনা যায়। আমরা যদি জুলাই সনদের বিষয়বস্তুর দিকে তাকাই, দেখি এটি তাত্ত্বিকভাবে সুশাসনের জন্য একটি সম্ভাবনাময় কাঠামো। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই কাঠামো বাস্তবায়নের উপযুক্ত পরিবেশ কি বাংলাদেশে আছে? প্রশাসনিক দক্ষতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান- এসব ছাড়া কোনো সংস্কারই টেকসই হয় না। আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রশাসন এখনো দলীয় প্রভাবমুক্ত নয়, দুর্নীতির শিকড় এখনো গভীর, এবং বিচারব্যবস্থা এখনো সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। এই বাস্তবতায় জুলাই সনদের প্রতিটি শব্দ যেন এক ধরনের তাত্ত্বিক আদর্শবাদে আটকে আছে। সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো সময়ের অপ্রতুলতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা গেছে, সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা টেকে না, কারণ সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই অগ্রাধিকার বদলে যায়। জুলাই সনদের সাফল্য নির্ভর করবে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ওপর- অর্থাৎ, ক্ষমতার পালাবদল হলেও যদি এই সনদের মূলনীতি টিকে থাকে, তাহলেই এটি দীর্ঘমেয়াদি ফল দেবে। এখন প্রয়োজন, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সীমিত স্বার্থ ছাড়িয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে একে অপরের সঙ্গে কাজ করা। বিএনপির আপত্তিকে শত্রুতার চোখে না দেখে আলোচনার সূচনা হিসেবে দেখা দরকার। সরকারও যদি এই নোট অব ডিসেন্টকে গণতন্ত্রের একটি উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে তা হবে পরিণত রাজনীতির লক্ষণ। বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে সুশাসন ও সংস্কারের স্বপ্ন, অন্যদিকে বিভাজন ও অবিশ্বাসের বাস্তবতা। এই দুইয়ের টানাপোড়েনের মধ্যেই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। জনগণ এখন প্রশ্ন করছে- এই সংস্কার কি সত্যিই তাদের জন্য, নাকি কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য? জুলাই সনদ যদি সত্যিই জনগণের দলিল হতে চায়, তাহলে এখনই সময় তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনার। জনগণকে বাদ দিয়ে কোনো ঐকমত্যই দীর্ঘস্থায়ী নয়। আর নোট অব ডিসেন্টকে যদি আমরা রাজনৈতিক সাহস হিসেবে দেখি, তাহলে তা ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক বিকাশে একটি ইতিবাচক ধাপ হিসেবে গণ্য হতে পারে। সর্বশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে- আমরা ঐকমত্যকে কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক করি, ভিন্নমতকে কতটা সহনশীলভাবে গ্রহণ করি, এবং জনগণের অংশগ্রহণকে কতটা বাস্তব করে তুলি তার ওপর। যদি আমরা আবারও পুরোনো বিভাজনের রাজনীতিতে ফিরে যাই, তাহলে জুলাই সনদ কেবল একটি অপূর্ণ স্বপ্ন হয়েই থাকবে। কিন্তু যদি আমরা সাহসী হই, স্বচ্ছ হই, এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সামনে এগোই- তাহলে এই সনদই একদিন বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মাইলফলক হয়ে উঠবে। শেষ কথা - জুলাই সনদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পরিবর্তনের আসল শক্তি জনগণের মধ্যেই নিহিত। ঐকমত্য যদি জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া গড়ে ওঠে, তবে তা কাগজে থাকবে, । আর গণতন্ত্র যদি কেবল নেতৃত্বের বৃত্তে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা টিকবে না। এখন প্রয়োজন জনগণকে রাষ্ট্রগঠনের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনা- তবেই জুলাই সনদ সত্যিকারের ঐক্যের দলিল হয়ে উঠবে, আর “নোট অব ডিসেন্ট” হবে নতুন গণতান্ত্রিক চেতনার সূচনা। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা। ডেল্টা টাইমস/রাফায়েল আহমেদ শামীম/সিআর/এমই |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |