|
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক লড়াই: বাংলাদেশ কোথায়?
সাদিয়া সুলতানা রিমি:
|
![]() ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক লড়াই: বাংলাদেশ কোথায়? বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কেন্দ্র হলো বঙ্গোপসাগর। ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা এ দেশটি কেবল সমুদ্রতীরবর্তী রাষ্ট্রই নয়, বরং একটি সম্ভাব্য ট্রেড ও কৌশলগত হাব। বঙ্গোপসাগর হয়ে মালাক্কা প্রণালীর দিকে যে সামুদ্রিক রুট গেছে, তা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত বাণিজ্য পথগুলোর মধ্যে একটি। এ পথ দিয়েই বিশ্বের অর্ধেকের বেশি কাঁচামাল, তেল ও পণ্য পরিবহন হয়। ফলে চীন ও ভারতের মতো শক্তিধর দেশগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেরও নজর রয়েছে এই অঞ্চলে। চীন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা সমুদ্রপথে সিল্ক রুট প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ করছে; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র “ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক” নীতির মাধ্যমে এখানে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে চায়। মাঝখানে বাংলাদেশ চেষ্টা করছে—কোনো পক্ষের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হয়ে, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখে এগিয়ে যেতে। কিন্তু এই পথটা কি এতটাই সহজ? চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর। পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল—এসব বড় প্রকল্পের পেছনে আছে চীনের বিনিয়োগ। আবার যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য, এবং মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও নির্বাচনী স্বচ্ছতা নিয়ে তারা চাপও সৃষ্টি করে। এদিকে ভারত, যাকে বাংলাদেশের “বিশ্বস্ত প্রতিবেশী” বলা হয়, তার সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক সম্পর্ক, তবে সীমান্ত হত্যা, তিস্তা পানি বণ্টন ও বাণিজ্য বৈষম্যের মতো বাস্তব সমস্যা সম্পর্ককে মাঝে মাঝে তিক্তও করে তোলে। ফলে বাংলাদেশকে সবসময়ই এক ধরনের সূক্ষ্ম কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হয়, যেখানে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকটে ফেলতে পারে। এত চাপের মধ্যেও বাংলাদেশের সামনে প্রচুর সুযোগ রয়েছে। সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি বা “ব্লু ইকোনমি” আজ বিশ্বে আলোচিত। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে রয়েছে বিশাল গ্যাস, তেল, খনিজ ও জীববৈচিত্র্যের সম্ভাবনা। চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা বন্দর দক্ষিণ এশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ট্রানজিট হাব হতে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি, ভৌগোলিক অবস্থান ও বাণিজ্য রুট তাকে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় করেছে। জাপান মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে, চীন উন্নয়ন করছে পায়রা বন্দরের, আর ভারত ট্রানজিট-রুট, সড়ক ও রেল যোগাযোগ বাড়াতে আগ্রহী। অর্থাৎ, সবাই বাংলাদেশকে কাছে পেতে চায়, কিন্তু বাংলাদেশকে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বেছে নিতে হবে কোন সম্পর্ক কতটা গভীর হবে। তবে এসব সুযোগের পাশাপাশিও বড় ঝুঁকি রয়েছে। অতিরিক্ত ঋণ নিয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প করলে দেশ শ্রীলঙ্কা বা লাওসের মতো ঋণসঙ্কটে পড়তে পারে। আবার মহাশক্তির বিরোধ যখন বাড়ে, তখন ছোট দেশগুলো তাদের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। সমুদ্রসীমা রক্ষা, জলদস্যুতা, ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ও জলবায়ু পরিবর্তনও বাংলাদেশের সমুদ্রভাগ ও নিরাপত্তায় বড় হুমকি তৈরি করছে। ফলে শুধু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নয়, সামরিক ও সামুদ্রিক সক্ষমতাও বাড়ানো জরুরি হয়ে উঠেছে। এই সব কিছু বিবেচনা করেই বাংলাদেশ ২০২৩ সালে ঘোষণা করে “Bangladesh Indo-Pacific Outlook”—একটি কৌশলগত নীতি দলিল। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ কোনো সামরিক জোটে অংশ নেবে না এবং কারো বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে না। বরং শান্তি, সংলাপ, আন্তর্জাতিক আইন, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্য সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দেবে। এই নীতি নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশ চাইছে একটি “নিরপেক্ষ কিন্তু সক্রিয়” ভূমিকা যেখানে সে ক্ষমতার রাজনীতির বদলে উন্নয়ন ও সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্ত করবে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টা দাঁড়ায় এভাবে বাংলাদেশ কি কারো দাবার গুটিতে পরিণত হবে, নাকি নিজেই হবে খেলোয়াড়? ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের লড়াই কেবল শক্তি প্রদর্শনের নয়, বরং বুদ্ধিমত্তা, স্বার্থরক্ষা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের লড়াই। যদি বাংলাদেশ বুদ্ধিমান কূটনীতি, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার, সামরিক সক্ষমতা ও নৈতিক অবস্থান বজায় রাখতে পারে, তবে এ অঞ্চল থেকে সে শুধু টিকে থাকবেই না, বরং হয়ে উঠতে পারে সংযোগের এক কেন্দ্রবিন্দু। ইন্দো-প্যাসিফিকের এই উত্তাল স্রোতের মাঝে বাংলাদেশের যাত্রা তাই হতে পারে এক সতর্ক, স্মার্ট এবং কৌশলী অগ্রযাত্রা। লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ডেল্টা টাইমস/সাদিয়া সুলতানা রিমি/সিআর/এমই |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |