|
রাজনীতি করার জন্য মা প্রতি মাসে ৫ হাজার করে টাকা দিতেন
সুমন কুমার রায় টাঙ্গাইল
|
|
ফজলুর রহমান খান ফারুক একাধারে রাজনীতিবিদ। অন্যদিকে সংস্কৃতিসেবী, শিক্ষা ও ক্রীড়ানুরাগী। গণমানুষের নেতা হিসেবে তিনি সবার মনে ঠাঁই করে নিয়েছেন। গত শুক্রবার টাঙ্গাইল জেলা পরিষদ কার্যালয়ে সময়ের আলোর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও জেলা পরিষদের পরপর দুবারের সফল চেয়ারম্যান তার রাজনীতিতে জড়ানোর বিষয় নিয়ে কথা বলেন। ফ র ফা : ১৯৬০ সালে মেট্রিক পাসের পর বাবা ভর্তি করে দিয়েছিলেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। থাকতাম খ্রিস্টানদের পরিচালিত একটি হোস্টেলে। কিন্তু হোস্টেলের কড়া নিয়ম আমার কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। সেখান থেকে পালিয়ে এসে করটিয়া সা’দত কলেজে ভর্তি হই। এতে বাবা ক্ষিপ্ত হন। কিন্তু মা বুঝিয়ে-শুনিয়ে ম্যানেজ করেন। আর সা’দত কলেজে পড়ার সময়ই ছাত্ররাজনীতি অর্থাৎ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আমার মা প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে দিতেন এবং সেই টাকা আমি রাজনীতির পেছনে খরচ করতাম। রাজনীতিই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান-সাধনা। আমার ভেতরে, সেই কৈশোরেই বিশ্বাস জন্মেছিল-মানুষ হয়ে মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে বড় আর কিছু নাই। মানুষকে ভালোবাসা মানেই দেশকে ভালোবাসা। এই মানুষ এবং দেশকে ভালোবাসার আকাক্সক্ষা থেকেই আমি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হই। আর এ অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম বিখ্যাত রাজনীতিক ও মনীষীদের জীবনী পড়ে। হাইস্কুলে উঠার পর থেকেই আমার পাঠাভ্যাস গড়ে উঠেছিল। রাজনৈতিক নেতা ও মনীষীদের জীবনী পড়ে আমি খুব আনন্দ পেতাম। আমি রাজনীতি করি, আমার বাবা আবদুল হালিম খান শুরুতে যে তার পছন্দ করতেন তা বলা যাবে না। তিনি চাইতেন আমি মন দিয়ে লেখাপড়া করি। ভালো ছাত্র হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখি। সেভাবেই লেখাপড়ায় উৎসাহ দিতেন বাবা। ১৯৬০ সালে মেট্রিক পাসের পর ওই বছরই অর্থাৎ ১৯৬০ সালে ১৬ বছর বয়সে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি। এরপর আর আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৬২ সালে জেনারেল আয়ুব খান তার প্রণীত সংবিধান সারা পাকিস্তাতে প্রবর্তন করেন। ওই বছরই ছাত্ররা একত্রিত হয়ে টাঙ্গাইল মহকুমা ছাত্রলীগ গঠন করে। ছাত্রলীগের একটি বিশেষ সম্মেলনে আমি (ফজলুর রহমান খান ফারুক) সর্বসম্মতিক্রমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। ১৯৬২ সালে ১১ দফা আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছি। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনবিরোধী আন্দোলন করেছি। একই সালে আমাকে গ্রেফতার ও কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। হাইকোর্টে রিট করে খালাস পাই। জেল থেকে বেরিয়ে দেখি বিএ পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় পেরিয়ে গেছে। তখন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তোফায়ের আহমেদ। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তার কাছে গেলাম। তিনি বললেন তার কিছুই করার নাই। এরপর জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান স্যারের কাছে গেলাম। সব শুনে সাইদুর রহমান স্যার জগন্নাথ কলেজ থেকে আমার ফরম ফিলামের ব্যবস্থা করে দিলেন। তবে পরীক্ষার সিট পড়েছিল (সাইদুর রহমান স্যারই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল) সা’দত কলেজেই। ভাষা আন্দোলন বলে কথা। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ¯েøাগান শুনলেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়তাম। স্কুল থেকে বেরিয়েও মিছিলে যেতাম। ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আমি স্কুলে পড়ি। এক দিন দেখি বর্তমান টাঙ্গাইল ক্লাবরোড ধরে ছাত্রদের একটি মিছিল আসছে সা’দত কলেজ থেকে। পরে জেনেছি ওই মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সৈয়দ নুরুল হোদা। পুলিশ মিছিলকারী ছাত্রদের কী মারটাই না মারলো। সৈয়দ নূরুল হুদাকে মারলো চোর-মারার মতো। পুলিশের ওই মারার দৃশ্য দেখে আমার চোখে পানি এসে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে-পুলিশ কেন ওদের এভাবে মারছে। পুলিশ কি বাংলা ভাষা চায় না। ভাষা আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েই বাঙালি বুঝতে পারে পাকিস্তান তাদের দেশ হতে পারে না। ধীরে ধীরে স্বাধিকার চেতনার আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জাতি সংগঠিত হতে শুরু করে। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তারা। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ভেতরেই ‘গোপনে’ স্বাধীনতার বীজ বপন করে রেখেছিলেন। বাংলার মানুষ তা বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাতেই তো পুরো জাতি একাট্টা হয়েছিল তার পেছনে। তা ছাড়া কোনো নেতা যখন কোন ধরনের ফাঁকফোকর না রেখে তার দেশের মানুষকে ভালোবেসে জাতির স্বপ্নকে নিজের বুকে ধারণ করে নির্ভয়ে এগিয়ে যান, তখন সেই নেতাকে মানুষ কতটা ভালোবাসে তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। সময়ের আলো : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তো আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। ফ র ফা : বঙ্গবন্ধু তরুণ নেতাদের প্রচন্ড ভালোবাসতেন। আমিও তার অপার ¯েœহ পেয়েছি। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার পর রাজ্জাক ভাইয়ের নেতৃত্বে (প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, শরিয়তপুর) আমরা ১৬ ছাত্রনেতা এক দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বললেন খুব শিগগিরই নির্বাচন হবে। আমরা নির্বাচনে যাব। তোমরা এলাকায় যাও। নির্বাচনের প্রস্তুতি নাও। দলকে সংগঠিত করো। এ নির্বাচন নেতা হওয়ার নির্বাচন না, মরণফাঁদে পা দেওয়ার নির্বাচন। যুদ্ধ হলে প্রবীণ নেতা কেউ কেউ সারেন্ডার করতে পারেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তোমরা কেউ সারেন্ডার করবা না। মনে রাখবা নির্বাচনও হবে, যুদ্ধও হবে। যুদ্ধ কীভাবে পরিচালিত হবে তার সব ব্যবস্থাই করা আছে। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে আমি সর্বকনিষ্ঠদের মধ্যে একজন। ওই সময় মির্জাপুর থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হই। তখন আমার বয়স মাত্র ২৫ কি ২৬ বছর। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হই। আমি ভোট পাই ৪২ হাজার ১৯টি। আর নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী ন্যাপের এমএ বাসেত পান ২ হাজার ৬৩৯ ভোট। স আ : আপনি তো দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনেও জয়ী হন। ফ র ফা : হ্যাঁ, ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিজয়ী হই। সে নির্বাচনে আমি ৪২ হাজারেরও বেশি ভোট পাই। দীর্ঘদিন টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর কাউন্সিলরের মাধ্যমে দলের জেলা সভাপতি নির্বাচিত হই। সময়ের আলো : কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তো আপনারা রক্ষা করতে পারেননি। ফ র ফা : বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও উদারতার সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ হয়তো তাঁকে বø্যাকমেইল করেছিল। তারপরও বঙ্গবন্ধু তাঁর ভালোবাসা দিয়েই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আমরা সেই সুযোগ তাঁকে দেইনি। তা ছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তো ছিলই। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এ হত্যাকান্ডের বিচারের পথ বন্ধ করে রাখা হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই যে দীর্ঘ গ্যাপ, এ গ্যাপের কারণেই এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে যারা ছিল, তাদের মামলায় আসামি করা যায়নি। সময়ের আলো : দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে আপনার। এখন আপনার লক্ষ্য কী? ফ র ফা : রাজনীতির মধ্য দিয়ে মানুষের কল্যাণ করাই আমার ব্রত। এটা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। দেশের সংবিধান প্রণয়নে অংশ নিয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদের সদস্য ছিলাম আমি। সারা জীবন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এখনও মানুষ আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। মন্ত্রী হয়তো হতে পারিনি। বিন্তু আমি বলব জীবনে যা পেয়েছি, যথেষ্ট পেয়েছি। আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে জেলা পরিষদের আমি নির্বাচিত চেয়ারম্যান। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। চলার পথে কোনো ভুলত্রুটি থাকলেও থাকতে পারে। জীবনে ব্যর্থতা এবং সফলতা দুটোই আছে। তারপরও আমি মনে করি আমি নিশ্চয়ই একজন সফল মানুষ। এ জন্য মহান আল্লাহতায়ালার কাছে শুকরিয়া জানাই। আমি একজন ক্ষুদ্র মানুষ, তবুও বলব এই জীবনে বহু ভাঙা-গড়া, বহু উত্থান-পতন দেখেছি। অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, কিন্তু কাজও করার চেষ্টা করেছি, এসব লিখে রেখে যেতেই চাই। শুরু করেছি। এখনও শেষ হয়নি। আল্লাহমাবুদ জানেন শেষ করে যেতে পারব কিনা। |
| « পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |