১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানি আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। উৎসুক পাঠকরা লক্ষ্য করলে দেখবেন, সেদিন রাত ৮টা ৪০ মিনিটে আমরা চট্টগ্রামে নিয়োজিত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের (ইপিআর) সশস্ত্র সৈন্যদের সংগঠিত করে সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। এর দু’ঘণ্টা পর, রাত সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্য স্থানে বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় পাকিস্তানিদের ‘বাঙালি হত্যাযজ্ঞ’।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই গণহত্যার কার্যক্রমকে আকস্মিক এবং পরিকল্পনাহীন বলে অভিহিত করার কোনো অবকাশ নেই। পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতারা কয়েক সপ্তাহ ধরে নিজেদের মধ্যে ষড়যন্ত্রমূলক ব্যাপক ও বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে ঠান্ডা মাথায় বাঙালি হত্যার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। সেই পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ীই পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট নেতারা গণহত্যার মতো জঘন্য অপরাধ সংগঠিত করে। গণহত্যার এই ঘৃণ্য অভিযানে ধ্বংস হয় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির এবং রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে জন্ম নেয় সম্ভাবনাময় এক নতুন রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। পাকিস্তানি নেতাদের কাছে ব্যাপক গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা পরিসংখ্যানের রেখাচিত্রের ওঠানামার মতো নিছক কিছু তথ্য মাত্র। তার বাইরে পাকিস্তানিদের কাছে মানুষের জীবনের কোনো মূল্য ছিল না। সেই গণহত্যায় সভ্যতার বেদীমূলে বাংলার কত মানুষকে যে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে, আজও তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা হয়নি। এর বিস্তারিত ঘটনা হয়তো জানতেও পারবে না কেউ কোনোদিন।বাঙালি জাতির ইতিহাসের সেই চরম সংকটকালে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে যখন অসংখ্য নারী, পুরুষ, শিশু করুণভাবে মৃত্যুবরণ করছে প্রতিটি মুহূর্তে বৃহৎ শক্তি হিসেবে পরিচিত কয়েকটি রাষ্ট্র তখন দেখিয়েছে বেদনাদায়ক উদাসীনতা, মানব-ইতিহাসে যুক্ত করেছে এক গøানিকর অধ্যায়। ‘বৃহৎ শক্তি’ এই দেশগুলোর উদাসীনতায় এমন ধারণারই সৃষ্টি হলো যে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা কেবল শক্তিশালীদেরই বিশেষ অধিকার ন্যায়বিচার প্রার্থনা হলো দুর্বলের অসহায়ত্বের প্রকাশ, আর ন্যায়পরায়ণতা যেন অতীতের অপ্রয়োজনীয় একটি অনুশীলন মাত্র।
অতি নিকটে অতীতের ঘটনাসমূহে, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী, দল এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের রাজনৈতিক বা অন্য কোনো স্বার্থের বিষয় ও অনেক সময় জড়িত থাকার কারণে একই ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসে অন্তর্ভুক্তির প্রয়াস চালানো হয়। সে কারণেই সমকালীন ঘটনাবলীকে ইতিহাসের ধাঁচে ঢেলে সাজানো যথেষ্ট কঠিন কাজ। আর সেখানে যদি প্রয়োজনীয় দলিল ও নথিপত্র সংগৃহীত না হয়ে থাকে তাহলে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো আরও সহজ হয়ে যায়। কারও ভ‚মিকাকে গৌণভাবে উপস্থাপন করা অথবা কোনো ব্যক্তির ভ‚মিকাকে অতিরঞ্জিত করার উদ্দেশ্যেই হোক, সত্যের এই বিকৃতি মানব-ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। এ দেশের ইতিহাসও সেই বিকৃতির প্রচেষ্টামুক্ত থাকেনি। ‘সত্য’ ইতোমধ্যেই বিকৃত হয়েছে কিছুটা। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনার বর্ণনা এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। তবুও সবশেষে সত্যের বিজয় সুনিশ্চিত, ‘সত্য’ই টিকে থাকবে ইতিহাসে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, ১নং সেক্টর কমান্ডার, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, সাবেক মন্ত্রী।
