মানবসেবার ১৪ উদাহরণ: আল্লাহর সন্তুষ্টি যেখানে
ডেল্টা টাইমস্ ডেস্ক:
|
![]() মানবসেবার ১৪ উদাহরণ: আল্লাহর সন্তুষ্টি যেখানে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা ইহসান অবলম্বন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইহসান অবলম্বনকারীদের ভালবাসেন।’ (সুরা বাকারা: ১৯৫) রাসুল (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা দয়ালুদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা জমিনে যারা বসবাস করছে তাদের প্রতি দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৪৯৪১) ১️. রোগীর সেবা: ঈমান ও সহানুভূতির অঙ্গীকার রোগীর সেবা ইসলামি সমাজের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। এটি শুধু মানবিক নয়, বরং ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। নবী (স.) বলেছেন, ‘প্রতিটি মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের পাঁচটি হক রয়েছে... (তার মধ্যে একটি হলো) রোগীকে দেখতে যাওয়া।’ (সহিহ বুখারি: ৫৪৬৫) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যখন কোনো মুসলিম তার (অসুস্থ) মুসলিম ভাইয়ের সেবায় নিয়োজিত হয়, সে ফিরে আসা পর্যন্ত জান্নাতের ফলবাগানে (তার ছায়ায়) অবস্থান করতে থাকে।’ (সহিহ মুসলিম: ২৫৬৮) প্রয়োগ: রোগীর খোঁজ নেওয়া, চিকিৎসায় সহযোগিতা, মানসিক সাহস জোগানো, আর্থিক সহায়তা প্রদান। ২️. দান-সদকা: সম্পদের শুদ্ধি ও সামাজিক ভারসাম্য দান-সদকা ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার হৃদয়। এটি সমাজে সম্পদের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং হৃদয়কে পবিত্র করে। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘তাদের সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের অধিকার।’ (সুরা জারিয়াত: ১৯) রাসুল (স.) বলেছেন, ‘জাকাত আদায় করবে। কারণ জাকাত হলো সম্পদের পবিত্রতা, তা তোমাকে পবিত্র করবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে। অসহায়, মিসকিন, প্রতিবেশী ও অভাবীদের হকের প্রতি লক্ষ রাখবে। (মুসনাদে আহমদ: ১২৩৯৪) প্রয়োগ: জাকাত, সদকা, ফিতরা, স্বেচ্ছাদান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অর্থায়ন। ৩. ঋণগ্রস্তদের সহায়তা: সহমর্মিতার দায়িত্ব ঋণগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো ইসলামি সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘যদি কেউ কষ্টে থাকে, তবে তাকে স্বচ্ছল হওয়া পর্যন্ত সময় দেওয়া উচিত। আর যদি ক্ষমা করো, তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম।’ (সুরা বাকারা: ২৮০) নবী (স.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি কোনো ঋণগ্রস্তকে সময় দেয় বা ক্ষমা করে দেয়, আল্লাহ তাকে কেয়ামতের কঠিন দিন থেকে রক্ষা করবেন।’ (সহিহ মুসলিম: ৩০০৬) প্রয়োগ: করজে হাসানা প্রদান, সময় বাড়ানো, ঋণ মাফ করা। ৪. এতিমের যত্ন: সমাজের দুর্বল শ্রেণির প্রতি দায়িত্ব ‘কাজেই আপনি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হবেন না’। (সুরা দুহা: ৯) রাসুল (স.) বলেছেন- ‘আমি এবং যে ব্যক্তি এতিমের দায়িত্ব নেয়, জান্নাতে এভাবে (শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুল দ্বারা ইঙ্গিত করে) থাকব।’ (সহিহ বুখারি: ৫৩০৪) প্রয়োগ: শিক্ষা, লালন-পালন, অর্থনৈতিক সহায়তা, অভিভাবকত্ব। ৫. বন্দি ও অসহায়দের সহায়তা ‘তারা ভালোবাসার কারণে খাদ্য দেয় এতিমকে, মিসকিনকে ও বন্দিকে।’ (সুরা দাহর: ৮) রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাওয়াও, অসুস্থ ব্যক্তির শুশ্রূষা করো এবং বন্দীকে মুক্ত করো।’ (বুখারি: ৫৬৪৯) প্রয়োগ: আইনি সহায়তা, মুক্তির প্রচেষ্টা, শিক্ষা ও পুনর্বাসন। ৬️. শিক্ষা ও জ্ঞান বিতরণ ‘আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা করে।’ (সুরা নাহ্ল: ৪৪) নবী (স.) বলেছেন- ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম তারা, যারা নিজেরা কোরআন শিখে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।’ (সহিহ বুখারি: ৫০২৮) প্রয়োগ: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা, জ্ঞান প্রচার। ৭️. পথিক ও ভ্রমণকারীর সহায়তা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- ‘আত্মীয়-স্বজনকে দিবে তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: ২৬) রাসুল (স.) বলেছেন- ‘পথ না চেনা ব্যক্তিকে পথ দেখিয়ে দেয়া তোমার জন্য একটি সদকা।’ (জামে তিরমিজি: ১৯৫৬) প্রয়োগ: খাবার, আশ্রয়, পথনির্দেশ ও নিরাপদ যাত্রার সহায়তা। ৮️. দাসমুক্তি ও মানবমর্যাদা ‘অতঃপর তা হলো—কোনো দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে আহার করানো...।’ (সুরা বালাদ: ১৩-১৪) রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে কেউ কোনো দাসকে মুক্ত করবে সেটা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিপণ হিসেবে বিবেচিত হবে।’ (মুসনাদে আহমদ: ৪/১৪৭, ১৫০) প্রয়োগ: সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা। ৯️. আত্মীয়তার বন্ধন ‘পিতা-মাতা ও আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর।’ (সুরা নিসা: ৩৬) নবীজি (স.) বলেন যে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।’ (সহিহ বুখারি: ৬১৩৬) প্রয়োগ: আত্মীয়দের সহযোগিতা, সম্পর্ক রক্ষা ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা। ১০. প্রতিবেশীর অধিকার ‘পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্থ, নিকট প্রতিবেশী, দুর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করো।’ (সুরা নিসা: ৩৬) রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘ওই ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ ১১২) প্রয়োগ: সহায়তা, নিরাপত্তা, পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতা। ১১. প্রাণীর প্রতি দয়া ‘তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের জন্য তাতে শীত নিবারক উপকরণ ও বহু উপকার রয়েছে এবং তা থেকে তোমরা আহার করে থাকো। তোমরা যখন তাদের সন্ধ্যাবেলা চারণভূমি থেকে গৃহে নিয়ে আসো এবং সকালবেলা তাদের চারণভূমিতে নিয়ে যাও তখন তোমরা এর সৌন্দর্য উপভোগ করো। তারা তোমাদের ভার বহন করে নিয়ে যায় এমন দেশে, যেখানে তোমরা অক্লান্ত পরিশ্রম ছাড়া পৌঁছা সম্ভব নয়।’ (সুরা নাহল: ৫-৭) রাসুল (স.) বলেছেন, ‘তোমরা এসব বাকশক্তিহীন পশুর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। সুস্থ সবল পশুর পিঠে আরোহণ করবে এবং এদের উত্তমরূপে আহার করাবে।’ (আবু দাউদ: ২৫৪৮) প্রয়োগ: প্রাণীর যত্ন, পানি সরবরাহ, গাছ লাগানো ও পরিবেশ রক্ষা। ১২. শ্রমিক ও কর্মচারীর অধিকার ‘আল্লাহ তাআলা জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের অধীন দাস-দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না যাতে তারা তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে? (সুরা নাহল: ৭১) নবী (স.) বলেছেন- ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও।’ (ইবনু মাজাহ: ২৪৪৩) প্রয়োগ: ন্যায্য পারিশ্রমিক, সম্মানজনক আচরণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, শ্রমিকের কল্যাণে সহযোগিতা। ১️৩. সাধারণ মানবিক সহায়তা ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই, কাজেই তোমাদের ভাইদের মধ্যে শান্তি-সমঝোতা স্থাপন কর, আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা দয়া প্রাপ্ত হও।’ (সুরা হুজরাত: ১০) নবীজি (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তা তার ভাইয়ের জন্যও পছন্দ না করে।’ (বুখারি: ১৩) প্রয়োগ: বিপদে সহায়তা, রক্তদান, স্বেচ্ছাসেবা, জরুরি সহায়তা তহবিল। ১️৪. রাষ্ট্রীয় ও সামষ্টিক দায়িত্ব ইসলামের দৃষ্টিতে মানবসেবা হলো ঈমানের বাস্তব রূপ। রোগীর সেবা থেকে শুরু করে শ্রমিকের অধিকার, এতিমের যত্ন থেকে প্রাণীর প্রতি দয়া—সবকিছুই সমাজকে ন্যায়, ভালোবাসা ও শান্তির পথে নিয়ে যায়। মুসলিম সমাজ যদি এই শিক্ষাগুলোকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে, তাহলে একটি ন্যায়নিষ্ঠ, সহানুভূতিশীল ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠন সম্ভব হবে। সুপারিশ ব্যক্তিগতভাবে: মানবিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও বাস্তবায়ন করা। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে: শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজসেবা করা। রাষ্ট্রীয়ভাবে: সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিত করা। এক কথায়, ‘মানবসেবাই খোদার সেবা’—এ আদর্শেই ইসলাম একটি কল্যাণমুখী সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মানবসেবার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন ডেল্টা টাইমস্/আইইউ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |