আপনি আমি আমাদের বাংলাদেশ
রেহানা ফেরদৌসী:
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৫, ৩:৫৭ পিএম আপডেট: ০৭.১০.২০২৫ ৪:০৭ পিএম

আপনি আমি আমাদের বাংলাদেশ

আপনি আমি আমাদের বাংলাদেশ

দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন আমরা সকলেই দেখি। উন্নত, সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল বাংলাদেশ গড়ার কথা আমাদের প্রত্যেকের মনে বাস করে। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে কবে? কখনো আমরা ভাবি, দেশের পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সরকারের উদ্যোগ, নীতি, আইন বা শাসনব্যবস্থার সংস্কার। সত্যি কথা হলো—দেশ বদলাতে হলে প্রথমে আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে। আমাদের আচরণ, চিন্তা, মনোভাব ও অভ্যাসই দেশের প্রকৃত পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি।

আমরা সবাই দেশ বদলাতে চাই, কিন্তু নিজের মধ্যে বদল আনার জন্য অনেক সময়ই অনীহা দেখি। ‘আমি তো একা, আমার ছোট পরিবর্তন দিয়ে কী হবে’—এমন মানসিকতা খুব সাধারণ। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। যদি আমরা প্রত্যেকেই নিজের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রচেষ্টা শুরু করি, নিজের জীবনকে দৃষ্টান্তমূলক করে তুলি, তবে দেশের বৃহৎ পরিকাঠামোও স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তিত হবে। দেশের উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে হলে সবার আগে নিজেকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা নিজেরা না বদলালে দেশের জন্য কল্পিত স্বপ্ন শুধু স্বপ্নেই থেকে যাবে।

একজন আদর্শ নাগরিক হওয়ার প্রথম ধাপ হলো নিজের মনকে বিশ্লেষণ করা। হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা এবং নেতিবাচক ভাবনা—এগুলো সমাজ ও ব্যক্তির উন্নয়নের অন্তরায়। যারা এসবের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক সীমিত করা প্রয়োজন। নেতিবাচক বা আক্রমণাত্মক মানুষের প্রভাব থেকে নিজেকে দূরে রাখলে মন শান্ত থাকে এবং উন্নতির পথ সুগম হয়। বিশেষ করে বর্তমান ডিজিটাল যুগে সামাজিক মাধ্যম আমাদের চিন্তা ও মনোভাবের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এমন প্ল্যাটফর্ম থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখা প্রয়োজন যা হতাশা, অশান্তি বা অনুতপ্ত ভাবনা উসকে দেয়।

পরিশ্রম, অধ্যবসায়, বই পড়া, জ্ঞান অর্জন—এসবই একজন মানুষের চরিত্রের ভিত্তি। মানুষের অভ্যাসই তার মৌলিক চরিত্র নির্ধারণ করে। অভ্যাস বদলালে মানুষও বদলে যায়—এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা মানে নিজের জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা। নিয়মিত বই পড়া, ধর্মীয় গ্রন্থ বা জ্ঞানভিত্তিক বই আমাদের দুঃখ কমায়, নতুন কিছু শেখায় এবং মানসিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে। এমনকি পড়াশোনা শুধু নিজের জন্য নয়; অন্যকে পড়তে উৎসাহিত করাও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো বদ অভ্যাস। অতিরিক্ত অলসতা, সময়ের অপচয়, অশ্লীল চর্চা, মিথ্যা ও ধোঁকাবাজি—এসব অভ্যাস কেবল ব্যক্তিগত উন্নয়নের পথে বাধা নয়, বরং সামগ্রিক সমাজ ও দেশের উন্নয়নের জন্যও হুমকি। এ ধরনের অভ্যাস ত্যাগ করা ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করে। যদি আমরা সচেতনভাবে নিজের জন্য সঠিক পথ নির্বাচন করি, নিজের ভালো ও উন্নতির জন্য কঠোর পরিশ্রম করি, তবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে উন্নতির সম্ভাবনা আমাদের অপেক্ষা করবে।

ধৈর্য ও পরিশ্রম—এগুলো হলো জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য মনের জোর ধরে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। জীবনে সফলতা আসে ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে; তাৎক্ষণিক ফলাফলের আশায় হতাশ হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজেকে শক্ত রাখাই এক প্রকার বিন্যাসমূলক ক্ষমতা। এভাবে ধীরে ধীরে আমরা নিজের চরিত্র গড়ে তুলি এবং সমাজে একটি শক্তিশালী আদর্শ স্থাপন করি।

রাষ্ট্র ও সরকারের পরিবর্তন কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপের উপর নির্ভরশীল নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন সম্ভব। আমরা চাইলে যে কোনো সময় নিজেকে বদলাতে পারি। কখন আমরা বুঝব যে নিজেকে বদলানোর প্রয়োজন? তখনই যখন আমাদের বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তরণের জন্য সচেতনতা ও প্রেরণা জন্মায়। আর যদি আমরা চাই না, কেউ বাইরের দিকে থেকে আমাদের বদলাতে পারবে না। সবই নির্ভর করে নিজের ওপর।

সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের প্রথম শর্ত হলো নিজের জীবনকে বুঝতে শেখা। নিজের ভেতরের অনুভূতিকে পর্যবেক্ষণ করা, মানসিক ও আত্মিক শক্তিকে বিকাশ করা এবং নিজের আচরণ ও মনোভাব পুনঃমূল্যায়ন করা—এসবই আমাদের জীবনকে সুন্দর করে। যে ব্যক্তি নিজেকে চেনার চেষ্টা করে, সে অন্যের প্রতি দয়া, সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। আর এই মনোভাবই সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি।

দেশপ্রেম শুধু আবেগ নয়, এটি দায়িত্বের পরিচায়ক। দেশের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা থাকলে, সেই চিন্তাভাবনা এবং ইতিবাচক কর্ম সবসময় ছড়িয়ে পড়বে। একজন মানুষ যদি নিজের চারপাশের মানুষকে উৎসাহিত করে, ভালো কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করে, তবে তা সমাজে ধীরে ধীরে একটি বৃহৎ পরিবর্তনের ঢেউ সৃষ্টি করে। এক সুন্দর ভাবনা হয়তো অন্যকে পরিবর্তনের পথে প্রথম ধাপ চালাতে সহায়তা করে।

সমাজে কিছু মানুষ নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু দেখার চেষ্টা করে এবং এগুলোকে বাধা হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু তাঁরা যতই বাধা দিক, আমাদের উচিত কবিগুরুর অমর বাণী অনুসরণ করা—“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে রে, তবে একলা চল রে।” একক প্রচেষ্টা কখনোই বৃথা নয়। একা থাকলেও সঠিক পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। পরিবর্তনের জন্য শুধু সংখ্যার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন সাহস, দৃঢ় মনোভাব এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।

নিজেকে বদলানো মানে কেবল নিজের উন্নতির জন্য নয়; এটি দেশের উন্নতিরও ভিত্তি। আমরা সবাই যদি নিজের মধ্যে ইতিবাচক গুণাবলী বিকাশ করি—দয়া, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, পরিশ্রম এবং সংযম—তাহলে সমাজও স্বাভাবিকভাবে বদলে যাবে। দেশ আমাদের collective প্রচেষ্টার প্রতিফলন। আমাদের ছোট ছোট ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো একত্রিত হয়ে বড় একটি সামাজিক ও জাতীয় পরিবর্তনের সূচনা করে।

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। হিংসা, অশান্তি, বিদ্বেষ এবং অনৈতিক কার্যকলাপ আমাদের দেশকে পিছনে টানে। আমাদের উচিত এই নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং সৃজনশীল, শিক্ষিত ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। সমাজে ভালো প্রভাব বিস্তার করা সহজ কাজ নয়, কিন্তু সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং অটল সংকল্প।

প্রকৃত দেশপ্রেম হলো আত্মপরিশ্রম, নিজের উন্নয়ন এবং অন্যকে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করা। আমরা চাইলে নিজের চরিত্রকে গড়ে তুলতে পারি—এবং সেই চরিত্রের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্রও পরিবর্তিত হয়। নিজেকে বদলাতে চাওয়ার মানে কেবল নিজের জন্য নয়; এটি দেশের জন্যও একটি ব্রত। আমাদের ছোট ছোট উদ্যোগ, ইতিবাচক মনোভাব, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের প্রচেষ্টা দেশের বৃহৎ ভবিষ্যতের জন্য এক শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে।

শেষমেষ, আপনি ও আমি বদলে গেলে দেশও বদলে যাবে। তাই পরিবর্তনের সূচনা হোক নিজেকেই দিয়ে। ছোট্ট, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা থেকে শুরু করা যাক—নিজেকে গড়ে তোলা হোক আদর্শ নাগরিক হিসেবে। নিজের জীবনকে সাজানো হোক দায়িত্ববোধ, সততা, পরিশ্রম এবং ন্যায়পরায়ণতার আলোকে। নিজে বদলাই, দেশ এমনিতেই বদলে যাবে। এই পরিবর্তন যেন শুরু হয় আজ থেকেই, আমাদের প্রতিটি কাজ, চিন্তা এবং সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে।

লেখক: সহ সম্পাদক,সমাজকল্যাণ বিভাগ, 
পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক)।


ডেল্টা টাইমস/রেহানা ফেরদৌসী/সিআর/আইইউ

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com