অটোরিকশা: ঢাকাবাসীর জীবনে নীরব মরণফাঁদ
মো. আরফাতুর রহমান:
|
![]() অটোরিকশা: ঢাকাবাসীর জীবনে নীরব মরণফাঁদ ঢাকার সড়কে প্রতিদিন গড়ে কয়েক লক্ষাধিক অটোরিকশা চলাচল করে। এর একটি বড় অংশই অননুমোদিত বা অবৈধভাবে পরিচালিত। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই শহরের প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে গলিপথ পর্যন্ত অবাধে চলাচল করছে। ফলে যানজট বাড়ছে, একইসাথে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। প্রধান সড়ক, ওভারব্রিজের নিচ, এমনকি ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে এসব যানবাহনের দাপটে হাঁসফাঁস করছে নগরবাসী। নগর পরিবহন ও সড়ক নিরাপত্তা সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে অটোরিকশা জড়িত দুর্ঘটনার হার বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য, উল্টো পথে চলাচল, অদক্ষ চালনা ও লাইসেন্সহীন ড্রাইভার—সব মিলিয়ে অটোরিকশা এখন নগর সড়কের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ যান। শাহবাগ, ফার্মগেট ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। অনেক সময় সামান্য ধাক্কাতেই যাত্রীরা ছিটকে পড়ছেন ব্যস্ত সড়কে, যার পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু বা গুরুতর আহত হওয়া। অনেক সময় সামান্য ধাক্কায় যাত্রী ছিটকে পড়ছেন সড়কে, যার পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব। আইনের কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় অটোরিকশা চালকরা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। তাদের কোন লাইসেন্স লাগে না চালনার জন্য । ফলে শাস্তির ভয় না থাকার কারণে বিভিন্ন গাড়িকে আঘাত করতেও তোয়াক্কা করে না। শুধু তাই নয়, রাস্তায় পথচারিকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে কুন্ঠিতবোধ করে না। সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সংগঠন “নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)” ও বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী: ২০২২ সালে ঢাকায় অটোরিকশা জড়িত দুর্ঘটনা ছিল প্রায় ১,২০০টি; ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১,৯২০টি — বৃদ্ধি ৬০%; ২০২৪ সালেও একই ধারা অব্যাহত রয়েছে, যেখানে প্রতি মাসে গড়ে ১৫০টিরও বেশি দুর্ঘটনা অটোরিকশা সংক্রান্ত। চলতি বছরে দুর্ঘটনা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে মার্চ ২০২৫ মাসে সারাদেশে ৫৮৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০৪ জন নিহত হয়েছেন (সূত্রঃ ঢাকা ট্রিবিউন), মে ২০২৫ মাসে সারাদেশে ৫৯৭টি দুর্ঘটনায় ৬১৪ জন নিহত হয়েছেন (সূত্রঃ প্রথম আলো), সেপ্টেম্বর ২০২৫ মাসে সারা দেশে ৪৪৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৭ জন নিহত হয়েছেন (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক)। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের প্রায় ৭৫% এর কোনো বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। এদের অনেকেই এসেছে গ্রামাঞ্চল থেকে, যাদের নগরের ব্যস্ত সড়কে চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। সঠিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই তারা রাস্তায় নেমে পড়ছেন, ফলে ট্রাফিক আইন, সিগন্যাল বা রোড রুলস মানা তাদের কাছে ঐচ্ছিক বিষয় হয়ে গেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এখনো মূলত কৃষিনির্ভর। কিন্তু—কৃষিতে আয় অনিশ্চিত ও মৌসুমি, জমি ছোট হয়ে যাওয়ায় অনেকের আর কৃষিতে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না, শিল্প ও বেসরকারি কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রামে খুব সীমিত ফলে টিকে থাকার জন্য অনেক তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষ ঢাকায় আসছেন বিকল্প জীবিকার খোঁজে। ঢাকায় অটোরিকশা চালক হতে বিশেষ কোনো শিক্ষা বা উচ্চ দক্ষতা প্রয়োজন হয় না। অনেকেই মালিকের কাছ থেকে দৈনিক ভাড়ায় (লিজে) গাড়ি নিয়ে চালায়, শুরুতেই বড় পুঁজি লাগেনা, দৈনিক ৮–১০ ঘণ্টা চালালে তুলনামূলক ভালো আয় করা যায় (গড়ে ৮০০–১৫০০ টাকা পর্যন্ত, এলাকাভেদে), এই তুলনামূলক সহজ প্রবেশাধিকারের কারণেই গ্রামের অনেক মানুষ দ্রুত এই পেশায় ঢুকে পড়ছেন। গ্রামে কৃষি বা দিনমজুরিতে যেখানে দৈনিক আয় ৩০০–৪০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ, ঢাকায় অটোরিকশা চালিয়ে— একই পরিমাণ শ্রমে দ্বিগুণ বা তারও বেশি আয় করা যায়, প্রতিদিন হাতে নগদ টাকা থাকে, যা পরিবারে পাঠানো সম্ভব-এই দ্রুত নগদ আয়ের লোভ অনেককেই শহরমুখী করে তুলছে। অনেকে গ্রামে পরিচিত কারো মাধ্যমে শহরে এসে সহজে পেশায় ঢুকে পড়ে। “একজন আসলে তার পিছু পিছু আরো কয়েকজন” — এই ধারা তৈরি হয়েছে। ঢাকার অনেক এলাকার গলিগুলো মূলত হেঁটে চলা বা রিকশার জন্য নকশা করা। কিন্তু এখন এই সংকীর্ণ পথগুলোয় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়মকানুন ছাড়াই চলছে। ফলে সামান্য একটি গাড়ি ঢুকলেই পুরো লেন জ্যাম হয়ে যায়, তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পুরান ঢাকার বংশাল, নাজির বাজার, নয়াবাজার, নাজির বাজার, চানখারপুল, নাজিমুদ্দিন রোড, চকব্জার, লালবাগ, ইসলামপুর, যাত্রাবড়ি, শনির আখড়া, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গেন্ডারিয়া, বাড্ডার মত এলাকার অলিগলিতে প্রতিদিন সকাল-বিকেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে — যার মূল কারণ এই অটোরিকশা। রাস্তা দখল করে যাত্রী নেওয়ার অজুহাত দেখিয়ে আটোরিকশা পার্কিং করে যাতায়াতের অসুবিধা সৃষ্টি করতে চলছে তাদের জীবিকা। এতে ভোগান্তিতে পড়ছে অসুস্থ রোগী, স্কুলগামী শিশু, পথচারী, বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। শুধু তাই নয় যানযটের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়ছে এর দরুণ ভয়ানক প্রভাব। এক পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, অটোরিকশাগুলো সাধারণত রাত ৮টা থেকে ভোর পর্যন্ত স্থানীয় ঘরবাড়ি বা গ্যারেজে চার্জে বসানো হয়। প্রতিটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় গড়ে ৪–৬টি ব্যাটারি থাকে। একটি অটোরিকশা পূর্ণ চার্জে ৬–৮ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ করে। ঢাকায় হাজার হাজার অটোরিকশা একসঙ্গে চার্জে বসলে রাতের বেলায় হঠাৎ অতিরিক্ত লোড তৈরি হয়। ফলস্বরূপ, স্থানীয় ট্রান্সফরমারগুলোতে চাপ পড়ে, অনেক জায়গায় ভোল্টেজ ড্রপ ও ঘনঘন লোডশেডিংয়ের ঘটনা ঘটে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ডিপিডিসির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর কিছু এলাকায় ট্রান্সফরমার পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় ব্যাটারিচালিত যানবাহনের চার্জিংকে “উল্লেখযোগ্য কারণ” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিদ্যুৎ ব্যবহারে ফাঁকি (চুরি) এখন বিদ্যুৎ খাতে একটি বড় মাথাব্যথা। অবৈধ, অননুমোদিত চার্জিং স্টেশন ও ঘরে চার্জ দেওয়ার কারণে ডিপিডিসি, ডেসকো ও পিডিবি বহুবার জানিয়েছে— এই চার্জিংয়ের কারণে লোড পূর্বাভাস মিলছে না। রাজস্ব আয় কমছে, কারণ বাণিজ্যিক হারে হিসাব হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ট্রান্সফরমার পুড়ে গেলে দায় নির্ধারণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার কারণে প্রতিবছর শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। প্রতিদিন কয়েক লক্ষ গাড়ি ঘরে বসে চার্জ হচ্ছে — কিন্তু সেই বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিল ঠিকমতো আসছে না। এভাবেই বছরে কয়েক শ’ কোটি টাকার বিদ্যুৎ ফাঁকি যাচ্ছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও সিএনজির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছে অটোপার্টস, ব্যাটারি ও রিকন্ডিশন স্পেয়ার পার্টসের বিশাল বাজার। কিন্তু এর বড় অংশই চলছে কর ফাঁকি, অবৈধ আমদানি ও ভ্যাট এড়ানোর মাধ্যমে — যার ফলে সরকার হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব। কাস্টমস কর্মকর্তাদের ভাষায়— “অটোপার্টসের আসল দাম ও ইনভয়েসে লেখা দামের মধ্যে পার্থক্য থাকে ৩–৫ গুণ পর্যন্ত।” ফলে আমদানিকারকের কর কম পড়ে, কিন্তু বাজারে বিক্রি হয় আসল দামে — মাঝের এই ফাঁকটাই কালোবাজারি আয়ের উৎস। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ক্রমবর্ধমান বাজারের সঙ্গে অটোপার্টস খাতও দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু এই পুরো খাতের বড় অংশই অঘোষিত, কর ফাঁকিপূর্ণ ও নজরদারির বাইরে। এখনই এই বাজারে কর কাঠামো ও লাইসেন্সিংয়ের আওতা না আনা হলে সরকার প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারানো অব্যাহত থাকবে। যদিও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধে সরকার ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করা হয়, তা বেশিরভাগ সময়ই থাকে সাময়িক। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় চালকরা সড়ক আইন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন, অনেকের নেই বৈধ লাইসেন্স। ফলে দুর্ঘটনার পরও অনেক সময় দায় নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রশাসন ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ব্যাটারিচালিত আটো ঢাকার রাস্তায় বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে চলছে। এভাবে চলতে থাকলে অতি শীঘ্রই ভয়াবহরূপ ধারণ করবে বলা বাহুল্য রাখে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিদ্যুৎ বিভাগ, রাজস্ব বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে এই খাত একটি অনিয়ন্ত্রিত ছায়া অর্থনীতি হিসেবেই থেকে যাবে। নিত্যদিনের যাতায়াতে অটোরিকশা অনেকের জন্য ‘শেষ ভরসা’। কিন্তু দুর্ঘটনার আশঙ্কায় যাত্রীরা অনেক সময় আতঙ্ক নিয়ে ওঠেন এই বাহনে। যাত্রীদের অভিযোগ—চালকরা হেলমেট না পরে চালান, ট্রাফিক নিয়ম মানেন না, অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করেন, এমনকি কখনো কখনো যাত্রী হয়রানিও ঘটে। বাংলাদেশে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণের মূল আইন হলো “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮” অনুসারে আটোরিকশা কোনো যানবাহন রেজিস্ট্রেশন ছাড়া রাস্তায় চলতে পারবে না। চালকদের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক থাকতে হবে। নির্দিষ্ট রুট পারমিট ছাড়া চলতে পারবে না। অযোগ্য বা অননুমোদিত যানবাহন চললে জরিমানা ও জব্দের আইনে আনতে হবে। অটোরিকশা ঢাকাবাসীর জীবনের এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হলেও এর লাগামহীনতা এখন নগর নিরাপত্তার বড় হুমকি। অনিয়ন্ত্রিত তিনচাকা শুধু দুর্ঘটনার কারণই নয়, এটি নগরের পরিবহন ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতাকেও সামনে নিয়ে আসছে। সময়মতো কড়াকড়ি পদক্ষেপ না নিলে এই ‘ছোট্ট তিনচাকা’ই হয়ে উঠতে পারে রাজধানীর সড়ক নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হুমকি। এখনই সময়, তথ্যভিত্তিক নীতি ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই নীরব মরণফাঁদ থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করার। লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট ও মোটিভেশনাল বক্তা। ডেল্টা টাইমস/মো. আরফাতুর রহমান/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |