মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক জায়ান্টদের মাস্টার প্ল্যান
সাদিয়া সুলতানা রিমি:
|
![]() মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক জায়ান্টদের মাস্টার প্ল্যান কিন্তু এই আপাত-নিরাপদ বিনিয়োগের আড়ালে কি লুকিয়ে আছে বিশ্ব অর্থনৈতিক জায়ান্টদের এক দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্ল্যান, যার শিকার হতে চলেছেন ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণি? এই প্রশ্নটি এখন গুরুতরভাবে ভাবার সময় এসেছে। মুদ্রাস্ফীতির বাজারে আপাতদৃষ্টিতে সোনা সুরক্ষা দিলেও, একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সত্য ভুলে গেলে চলবে না। সোনা এমন একটি সম্পদ, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয় না। আপনার কেনা সোনা যখন সিন্দুকে বাক্সবন্দী হয়ে থাকে, তখন সেই অর্থ বাজারে 'বাই রোটেশন' ঘোরার সুযোগ পায় না। অর্থ যদি বাজারে সঞ্চালিত না হয়, তাহলে নতুন শিল্প, ব্যবসা বা সেবা খাতে বিনিয়োগ হয় না, যার ফলে একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থমকে যায়। আজ মানুষ সঞ্চয় হিসেবে সোনা রাখলেও, কাল মুদ্রাস্ফীতির কারণে যখন খাদ্য, শিক্ষা বা অন্যান্য সেবা কেনার জন্য পর্যাপ্ত টাকা থাকবে না, তখন এই সিন্দুকবন্দী সোনাকেই বিক্রি করতে হবে। আর ঠিক তখনই কার্যকর হবে অর্থনীতির সবচেয়ে মৌলিক সূত্রটি। যখন লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের সঞ্চিত সোনা বিক্রি করতে বাজারে আসবে, তখন স্বর্ণের সরবরাহ (যোগান) অত্যাধিক বেড়ে যাবে এবং চাহিদার তুলনায় তা কয়েকগুণ ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতি বা বাজার ব্যবস্থার ফর্মুলা অনুযায়ী—চাহিদার চেয়ে যোগান বেশি হলে পণ্যের দাম অবশ্যই কমবে। এই পরিস্থিতিতে আপনার কেনা দুই লাখ টাকার সোনা হয়তো আপনার ক্রয়মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হতে পারেন। সামনে দাম আরও কমে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় মানুষ আরও দ্রুত বিক্রি করতে উদগ্রীব হবে, ফলে বাজারে যোগান আরও বাড়বে এবং দাম আরও কমবে এভাবে এক অনিবার্য লোকসানের চক্রে (Loss Cycle) মানুষকে ফেলে দেওয়া হবে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এই কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধির পর বিশ্ববাজারে সোনার দাম ৪০% পর্যন্ত নেমে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তরা একদিকে তাদের জমানো পুঁজি হারাবেন, অন্যদিকে গরিবরা পথে বসে যাবেন। এই প্রক্রিয়াটি সুকৌশলে মধ্যবিত্তদের নিঃস্ব করে দিয়ে বিত্তশালীদের আরও বিত্তবান হওয়ার সুযোগ করে দেবে, এবং সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য করা হবে। এই অনিয়ন্ত্রিত অসম বাজার ব্যবস্থার ধ্বস এড়াতে সোনা কেনা বন্ধ করাই প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে। কারণ, সোনা ব্যক্তিগত সম্পদ হলেও, কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মজুদ বা মুদ্রামান বজায় রাখার সঙ্গে ব্যক্তির সিন্দুকে গচ্ছিত সম্পদের হিসাব এক নয়। দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সোনা কেনার দিকে ঝুঁকে পড়ার মূল কারণ হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা এবং আমানত হারিয়ে যাওয়ার ভয়। সরকার যদি এমন একটি সুস্পষ্ট নীতি প্রণয়ন করতে পারে যে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার দায়-দায়িত্ব সরাসরি সরকারের, এবং ব্যাংক গ্রাহকের হয়রানি বন্ধ করা হয়, তবে মানুষ বিকল্প পদ্ধতিতে টাকা সংরক্ষণ করা থেকে বিরত থাকবে। টাকাকে অবশ্যই বাই রোটেশনে মার্কেটে ঘোরাতে হবে—এটি নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে দায়িত্বশীল ও জনবান্ধব হওয়ার বিকল্প নেই। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সোনা কেনার ক্ষেত্রে নারী সমাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য। আজ যে সোনা দ্রুত লাফিয়ে বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে, সেটি হয়তো একসময় আপনার পাত্তা দেবে না। তাই এটিকে একটি স্ক্যাম হিসেবে চিহ্নিত করে মনে প্রাণে ঘৃণা করুন। সোনা এখন আপনাদেরকে পাত্তা দিচ্ছে না এই অজুহাত যথেষ্ট, যাতে আপনারা এর উপর থেকে আস্থা সরিয়ে নেন। ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল হয়ে দেশের অর্থনৈতিক চক্রকে সচল রাখি। নাহলে এই মাস্টার প্ল্যান সফল হলে পথে বসার দিন আর খুব বেশি দূরে নয়। লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ডেল্টা টাইমস/সাদিয়া সুলতানা রিমি/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |