নদীভাঙন কবলিত উত্তরবঙ্গ ও জনজীবন
সুরাইয়া বিনতে হাসান
|
![]() নদীভাঙন কবলিত উত্তরবঙ্গ ও জনজীবন প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নদীর জলস্ফীতি বাড়লে এবং এর স্রোতের গতি তীব্র হলে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। বিশেষ করে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার জেলাগুলো যেমন, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ এই ভাঙনের প্রধান শিকার। গত কয়েকদিনে কুড়িগ্রামে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার নদীতে ৩৩টি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে এবং শতাধিক ঘর ও আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এছাড়াও উত্তরাঞ্চলে কুড়িগ্রাম, রংপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার কিছু এলাকায়, তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বন্যা ও ভাঙনসহ ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের নদীভাঙন একবারের ঘটনা নয়। এটি প্রায় পুরো বছর জুড়েই পর্যায়ক্রমে ঘটে, যদিও বর্ষা মৌসুমে (জুন–অক্টোবর) এটি সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নেয়। এক রাতে মানুষ হারায় তার জমি, ঘরবাড়ি, এমনকি জীবনের সমস্ত সঞ্চয়। নদী তীরবর্তী এলাকা যেন পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীতে। কোথাও বাঁধ ভেঙে নদীর পানি গ্রাস করে নেয় বসতভিটা, কোথাও আবার ফসলি জমি তলিয়ে যায় বন্যার পানিতে। চোখের পলকে বিলীন হয়ে যায় আবাদি জমি, বসতভিটা, স্কুল, মসজিদ, হাট-বাজার। যে মানুষটি গতকালও তার ফসলের মাঠে স্বপ্ন বুনছিলেন, আজ তিনি সব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয়হীন। একসময় যে জমিতে সোনালি ধানের শিষ দুলত, আজ সেখানে কেবল নদীর স্রোত আর ভাঙনের দাগ। এই দৃশ্য প্রতি বছরই উত্তরবঙ্গের এক রূঢ় বাস্তবতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বছর বছর একই দৃশ্য দেখা গেলেও কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনের তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না। সরকার নদীভাঙন রোধে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে তা বাস্তবায়নে ধীরগতি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব এখনো বড়ো চ্যালেঞ্জ। কোনো বাঁধ টেকে না, কোনো প্রতিশ্রুতি টেকসই হয় না। নদী তীর রক্ষায় নির্মিত বাঁধগুলো অল্প সময়েই ধসে পড়ে, আবার কোথাও কাজ হয় কাগজে-কলমে। স্থানীয় মানুষ বারবার দাবি জানিয়েও বাস্তব উন্নয়ন দেখে না। অথচ নদীভাঙনের ক্ষত শুধু ঘরবাড়ি নয়, এটা এক পুরো প্রজন্মের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। নদীভাঙন রোধের কার্যকর উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি, তবে তার সঙ্গে আরও বড়ো প্রয়োজন অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ। উত্তরবঙ্গের মানুষ পরিশ্রমী, সম্ভাবনাময়। তারা চায় কাজ, সুযোগ আর উন্নয়ন। অথচ অধিকাংশ শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে ঢাকাকেন্দ্রিকভাবে। ফলে উত্তরবঙ্গের তরুণরা কাজের খোঁজে বাধ্য হয়ে চলে আসে রাজধানীতে, যেখানে জীবনযুদ্ধ আরও কঠিন। সরকার যদি উত্তরবঙ্গে শিল্প স্থাপন করে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, তাহলে এই অঞ্চলের অর্থনীতি যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্যও খুলে যাবে নতুন জীবিকার পথ। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির পাশাপাশি হালকা শিল্প, গারমেন্টস, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও টেক্সটাইল শিল্প উত্তরবঙ্গে গড়ে উঠতে পারে। উন্নয়নের সমান বণ্টনই পারে উত্তরবঙ্গকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে। নদীভাঙন রোধের পাশাপাশি প্রয়োজন মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল করে তোলা, যাতে তারা শুধু বাঁচে না, বাঁচার স্বপ্নও দেখতে পারে। নদীভাঙন আজ উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনে এক স্থায়ী আতঙ্ক। নদীভাঙন রোধে শুধু বাঁধ নির্মাণই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক নদী তত্ত্ব, বিকেন্দ্রীকৃত শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা। তাহলেই নদীভাঙনের ক্ষতি থেকে উত্তরবঙ্গের মানুষকে টেকসইভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে। তাই এখনই সরকারকে এ সমস্যার প্রতি সুনজর দিতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি নদী ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। ডেল্টা টাইমস্/সুরাইয়া বিনতে হাসান/আইইউ
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |