মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন মানবসভ্যতার জন্য অনুপম উপহার। প্রতিটি মানুষের জন্যই তার জীবন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। তার অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১)
তিনি অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সত্যনিষ্ঠতা প্রভৃতি বিরল চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে বর্বর আরব জাতির আস্থা অর্জন করেছিলেন। ফলে সবাই তাকে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বস্ত উপাধিতে ভ‚ষিত করেছিল। দুনিয়ার মানুষকে তিনি অর্থ বা প্রভাব-প্রতিপত্তির দ্বারা বশীভ‚ত করেননি। বরং স্বভাবজাত উত্তম ব্যবহার দিয়ে বশীভ‚ত করেছিলেন। তার চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কলম : ৪)
মানুষকে তিনি কখনও তুচ্ছজ্ঞান ও হেয়প্রতিপন্ন করেননি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করে পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠতর স্বভাব-চরিত্রের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। সর্বোত্তম আদর্শের বাস্তবায়নকারী ও প্রশিক্ষক হিসেবেই তাকে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসনাদে আহমাদ, মেশকাত)
সমাজে যে যতটুকু মর্যাদার অধিকারী তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতেন তিনি। সাহাবায়ে কেরামকে নম্র ও সুন্দর ব্যবহারের উপদেশ দিতেন। অযথা ক্রোধ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতেন। তিনি মানুষকে সাবধান করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নম্র ও বিনয়ী হয় আল্লাহ তাকে উচ্চাসনে আসীন করেন আর যে অহংকারী হয় আল্লাহ তাকে অপদস্থ করেন।’ (মিশকাত)
অন্য ধর্মের লোকেরাও তার কাছে সুন্দর ও কোমল আচরণ লাভ করত। তার নমনীয়তা ও কোমলতার কারণে সাহাবি ও অমুসলিম সবাই তাকে প্রাণাধিক ভালোবাসতো। তার কোমল ব্যবহার সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়শা (রা.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) কঠোরভাষী ছিলেন না, এমনকি প্রয়োজনেও তিনি কঠোর ভাষা প্রয়োগ করতেন না। প্রতিশোধপ্রবণতা তার মধ্যে আদৌ ছিল না।’

মন্দের প্রতিবাদ তিনি মন্দ দিয়ে করতেন না, বরং মন্দের বিনিময়ে উত্তম আচরণ করতেন। তিনি ক্ষমাকে প্রাধান্য দিতেন। তিনি এতটা বিনয়ী ও নম্র ছিলেন যে, কথা বলার সময় কারও মুখমÐলের প্রতি দৃষ্টি রেখে কথা বলতেন না। কোনো অশোভন বিষয় উল্লেখ করতেন না। তিনি সব সময় মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন ও সদালাপ করতেন। তার মধুর বচনে সবাই অভিভ‚ত হত। তার অভিভাষণ শুনে সাধারণ মানুষ অশ্রæ সংবরণ করতে পারত না। তিনি জনগণকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘দয়ালু প্রভু আল্লাহর ইবাদত করো, ক্ষুধার্তকে খাদ্য প্রদান কর, সালামের বহুল প্রচলন কর এবং এসব কাজের মাধ্যমে বেহেশতে প্রবেশ কর।’ একদা এক ব্যক্তি নবী করিমকে (সা.) ইসলামে সবচেয়ে ভালো কাজ কোনটি প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি জানালেন, ‘অভুক্তকে খাওয়ানো আর চেনা-অচেনা সবাইকেই সালাম করা।’ (বুখারি ও মুসলিম)
তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিরহংকার, পরোপকারী, সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন আদর্শ মহামানব। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ওহির মাধ্যমে আমার কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছেন যে নম্রতা ও বিনয় অবলম্বন কর। কেউ যেন অন্যের ওপর গর্ব ও অহংকারের পথ অবলম্বন না করে এবং কেউ যেন কারও ওপর জুলুম না করে।’ (মুসলিম)
রাসুল (সা.) বহুলাংশেই স্বাবলম্বী ছিলেন। নিজের প্রয়োজনে কারও ওপর নির্ভরশীল হতেন না। নিজ হাতে জুতা মেরামত করতেন, কাপড় সেলাই করতেন, দুধ দোহন করতেন। সেবকদের কাজে সহায়তা করে আটা পিষতেন। নিজ হাতে রুটি তৈরি করে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে খেতেন। নিজে হাটবাজার থেকে সওদা নিয়ে আসতেন। পরিবারের কেউ কোনো কাজের সহায়তা কামনা করলে তখনই সাহায্যের জন্য সাড়া দিতেন। তার পারিবারিক কার্যকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে হজরত আয়শা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বাড়িতে অবস্থানকালে পরিবারের কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত থাকতেন। যখন নামাজের সময় হতো তখন তিনি নামাজের জন্য উঠে যেতেন।’ হজরত আনাস (রা.) বলেছেন, ‘পরিবারের প্রতি অধিক স্নেহপ্রবণ হিসেবে নবী করিম (সা.) থেকে বেশি অগ্রগামী আমি আর কাউকে দেখিনি। তিনি দিবারাত্রির সময় তিন ভাগে ভাগ করে নিতেন। এক ভাগ ইবাদত-বন্দেগি করতেন। অন্য ভাগ পরিবার-পরিজন ও গৃহের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতেন। আর এক ভাগ সময় তিনি নিঃস্ব-দুস্থজনদের জনসেবায় ব্যয় করতেন।
আমরা যদি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অনুপম গুণাবলী অনুশীলন করে চলি তাহলে আমরা ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি লাভ করব ইনশাল্লাহ।
সূত্র : আর-রাহীকুল মাখতুম