ইতিহাসের কয়েকটি নির্মম গণহত্যা
প্রকাশ: সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০১৯, ১২:০০ এএম

আর্মেনীয় গণহত্যা (১৯১৫-২৩)
তুরস্কের অটোম্যান শাসনামলে (১৮২১ থেকে ১৯২২) তৎকালীন আর্মি অফিসার এনভার পাশার নেতৃত্বে বিংশ শতাব্দীর সর্ববৃহৎ গণহত্যা সংঘটিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এবং তৎপরবর্তী সময়ে তুরস্ক শুধু ১.৮ মিলিয়নের অধিক আর্মেনীয় এবং অ-তুর্কিদের সরাসরি হত্যা এবং বিতাড়িতই করেনি, এ ছাড়াও হাজার হাজার আর্মেনীয় এবং অ-তুর্কিকে খাদ্যাভাবে মারা যেতে বাধ্য করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক তুর্কিরা এটাকে গণহত্যা বলে স্বীকার করে না বরং তারা বলে যে, এটা ছিল শুধুই সেই সব ব্যক্তিদের জন্য একটি গণবিতাড়ন প্রক্রিয়া যারা রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল।
সোভিয়েত রাশিয়ার স্ট্যালিন যুগ (১৯২৯-৫৩)
জোসেফ স্ট্যালিন নিজের জাতিকে টুকরো টুকরো  করেছিলেন। তিনি এটি করেছিলেন কারা অভ্যন্তরে এবং তার প্রতিষ্ঠিত এক্সটারমিনেশন ক্যাম্পের মাধ্যমে। ধারণা করা হয় প্রায় কুড়ি মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হয় এ সময়। এই কুড়ি মিলিয়নের মধ্যে দুই মিলিয়ন হলো দুর্ভিক্ষপীড়িত ইউক্রেনিয়ান কৃষক। স্ট্যালিন ১৯৩৭ সালে তার কুখ্যাত ‘০০৪৪৭’ অধ্যাদেশ দ্বারা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছিলেন সামাজিকভাবে ক্ষতিকর মানুষ আখ্যা দিয়ে।
দ্য হলোকস্ট (১৯৩৯-৪৫)

হলোকস্ট যদিও জঘন্য গহত্যার তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে তথাপি এই গণহত্যা এখনও সবচেয়ে নিন্দিত। হিটলারের নাজি বাহিনী কর্তৃক ইহুদিদের ইউরোপ মহাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণার প্রেক্ষিতে প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা  করা হয়েছিল যাদের  অর্ধেকই ছিল ইহুদি। এই গণহত্যা বিভিন্ন উপায়ে সম্পন্ন করা হয়, যার মধ্যে সরাসরি হত্যা, কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা, অনাহারে হত্যা, অতিরিক্ত কষ্টসাধ্য কাজের বোঝা চাপিয়ে হত্যা এবং হিটলারের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা।
হিরোশিমা ও নাগাসাকি গণহত্যা (১৯৪৫)
১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখজনক দুটি দিন।  এই দুটি দিনে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহর সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমা শহরে ফেলা হয় প্রথম আণবিক বোমা। এই বিস্ফোরণ কেড়ে নেয় প্রায় দুই লাখ প্রাণ এবং অনেকের কোনো হদিসই পাওয়া যায়নি। প্রথম বিস্ফোরণের ঠিক দুই দিন পর অর্থাৎ ৯ আগস্ট সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে নাগাসাকির একটি শিপইয়ার্ডের ওপর ফেলা হয় ২০ কিলোটন ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা যেদিন প্রায় ৭০ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়।
ভারত ভাগ (১৯৪৭)
ব্রিটিশ রাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ কলোনি থেকে ভারত ভাগের পদক্ষেপের ফলে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। নতুন ভ্রান্ত সীমানা নির্ধারণে অনেক মুসলমান, হিন্দু এবং শিখ ধর্মাবলম্বীরা দেখতে পেল যে তাদের বর্তমান বাসস্থান সঠিক স্থানে অবস্থিত নয়। লাখ লাখ মানুষ তাদের পৈত্রিক বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হলো এবং মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে তাদের নতুন বাসস্থানে গমন করতে বাধ্য হলো। অভিযানের সময় ধর্মীয় দলগুলোর মাঝে বিস্তার করল সহিংসতা ফলশ্রæতিতে তা রূপ নিল গণহত্যায়, নিহত হলো এক মিলিয়নের মতো মানুষ আর কপর্দকহীনভাবে স্থানান্তরিত হলো অগণিত।
চীনের গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব (১৯৪৯-৭৬)
চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসে ১৯৪৯ সালে এবং তারপর পরবর্তী দশকগুলোতে কমিউনিস্ট চায়নাতে প্রায় ৪৫ থেকে ৭০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। বেশির ভাগ হত্যাকাÐ সংঘটিত হয় দুটি ধারায়Ñ একটি হচ্ছে মাও সে তুংয়ের গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড কর্মকাÐ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ১৯৬৬-৬৭ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়। দ্য গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড ছিল প্রথম ধাক্কা যখন চীনের তৎকালীন নেতা মাও সে তুং কৃষির আধুনিকায়ন এবং সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ শুরু করেন। যার ফলে ১৯৫৮-৬১ সাল পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অনেক কৃষক এবং ভ‚মি মালিকের অনাহারে মৃত্যু হয় যা পরবর্তীতে গণহত্যার আকার ধারণ করে।
বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গণহত্যা
(মার্চ-ডিসেম্বর ১৯৭১)
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা কার্যক্রম অপারেশন সার্চলাইটের অধীনে মার্চ, ১৯৭১ থেকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী দলগুলো আনুমানিক ৩০ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করে। এ ছাড়াও, দুই লাখ থেকে চার লাখ বাংলাদেশি মহিলাকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সংঘটিত ঘটনাসমূহ গণহত্যা হিসেবে পরিচিতি পায়। যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও স্থানীয় দোসররূপে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী শীর্ষস্থানীয় বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। যুদ্ধ শেষ হবার অল্প কয়েকদিন পূর্বে সর্বাধিক সংখ্যক সুনির্দিষ্ট বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা এই দলটির দ্বারা পরিচালিত হয়।
কম্বোডিয়ার কিলিং ফিল্ডস (১৯৭৫-৭৮)
১৯৭৫ সালে খেমার রুজ বাহিনী কম্বোডিয়ার সরকার উৎখাতের মাধ্যমে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করে। খেমার রুজদের প্রথম কাজ ছিল সাবেক শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তাদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে হত্যা করা। এই তালিকায় সাবেক সরকারের সদস্য, সেনা সদস্য, সাংবাদিক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী এমনকি সাধারণ মানুষ যারা এদের ক্ষমতা দখলকে ভালো চোখে দেখত না তারা সবাই ছিলেন। ধারণা করা হয়, স্বল্পস্থায়ী এই গণহত্যায় হতাহতের সংখ্যা দুই মিলিয়নের কম ছিল না, যা কম্বোডিয়ার জনসংখ্যার কুড়ি ভাগ।
সার্ব কর্তৃক বসনিয়ান গণহত্যা (১৯৯২-৯৫)
১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে যুগোসøাভিয়া প্রজাতন্ত্রের বসনিয়া হার্জেগোভিনা সরকার যুগোসøাভিয়া থেকে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতা ঘোষণার পরবর্তী কয়েক বছর বসনিয়ার সার্ব বাহিনী যুগোসøাভিয়ার সার্ব অধ্যুষিত সেনাবাহিনীর সহায়তায় বসনিয়ার বেসামরিক বসনিয়াক মুসলিম এবং ক্রোয়েশীয় নাগরিকদের লক্ষ্য করে বর্বর হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত করে। এর ফলে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এক লাখ মানুষ নিহত হয় যার আশি ভাগই ছিল বসনিয়ান মুসলমান। সার্বিয়ানরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের দ্বারা ধর্ষিত হয় অসংখ্য নারী এবং শিশু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে নাজি বাহিনী কর্তৃক ইহুদি এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধনের পর এই সার্বিয়ান হত্যাযজ্ঞ ছিল সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধ।
রুয়ান্ডা গণহত্যা (১৯৯৪)
রুয়ান্ডার গণহত্যা কোনো রাজনৈতিক কারণে হয়নি। বরং বৃদ্ধি পেতে থাকা উপজাতীয় বিভেদের ফলে সংঘটিত হয় এই জঘন্য গণহত্যা। এই গণহত্যার ফলশ্রæতিতে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ লাখ থেকে এক মিলিয়ন মানুষ।
সংখ্যালঘু তুসি সম্প্রদায় শতাব্দী ধরে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে আরেকটি উপজাতি সম্প্রদায় হুতু গোষ্ঠীকে দমিয়ে রেখে দখল করে রেখেছিল দেশটির শাসনভার। ১৯৬২ সালের কথা, তখন হুতু সম্প্রদায় বিদ্রোহ শুরু করে ক্ষমতাসীন তুসি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। চরম উত্তেজনা এবং বিদ্রোহ যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়, যখন হুতু প্রেসিডেন্ট রহস্যজনকভাবে ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। এটা ছিল হুতু সম্প্রদায় কর্তৃক একটি রক্তাক্ত প্রতিশোধ তুসিদের বিরুদ্ধে। যেহেতু হুতু নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে এই গণহত্যা সম্পাদিত হয়েছিল তাই গণহত্যার সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি।

ষ গ্রন্থনা : সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন


« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com