মরুর দেশের অসহায় শিশু : হায় সভ্যতা
অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ: শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৯, ৩:০৬ পিএম

মরুর দেশের অসহায় শিশু : হায় সভ্যতা

মরুর দেশের অসহায় শিশু : হায় সভ্যতা

মন ভার করা এক ছবি ভাসছে মিডিয়ায়। একটি শিশু হাতে তার পুঁটলি। একা পার হচ্ছিল মরুভূমি। মধ্যপ্রাচ্য এখন অগ্নিগর্ভ এক জায়গা। একদা সভ্য আর সভ্যতার উদাহরণ দেশ-শহরগুলো আজ ধ্বংসস্তূপ। মেসোপটেমিয়া নামের ইরাক এখন মানুষের বসবাস অযোগ্য এক জনপদ। সেখানে নারী, শিশু কেউই নিরাপদ না। ইরাক লিবিয়ায় মিশন শেষ হবার পর মুরুব্বিরা ধরলেন সিরিয়াকে। দামেস্কাস কেমন শহর যারা ইতিহাস জানেন তাদের অজানা কিছু না। এটা মানি সেখানকার নাগরিকরা আগের মতো নাই। নাই বলতে আমি যাদের দেখেছি বা যারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের ভেতর এক ধরনের উগ্রতা আছে। দীর্ঘ সময় ধরে একনায়ক কিংবা এককেন্দ্রিক শাসনের অধীনে থাকার কারণে হয়তো তারা এমন। শাসন, শাসক আর রাজনীতির প্রভাব থাকে জন আচরণে। বিশ্ব রাজনীতির কঠিন চাপে মরুর দেশগুলো আজ তাদের চরিত্র হারিয়েছে। হারিয়েছে তাদের মূল পরিচয়।

বলছিলাম একটি ছবির কথা। যে ছবিতে শিশুটি বাঁচার জন্য কঠিন মরুভূমির এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাচ্ছিল। যেতে পারত না মাঝপথেই তাকে বিদায় নিতে হতো বলা মুশকিল অতবড় মরুভূমিতে আরও কত শিশু বা মানুষ চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে কে জানে? কে তার খবর রাখে? সিরিয়া এখন বিশ্বের নিউজ আইটেম মাত্র। এমন হয়ে গেছে যে রোজ মিডিয়া খুলেই মানুষ ভাবে আর কয়জন মরল সেখানে। যেন মৃত্যুই হচ্ছে কাক্সিক্ষত কোনো খবর। এমন বাস্তবতায় কেউই নিরাপদ না। বিশ্ব মোড়ল নামে পরিচিত আমেরিকা সঙ্গে তার মিত্ররা একদিকে। আরেকদিকে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ তাদের সঙ্গে। যারা এখন যেকোনো পরিচয়ের বাইরে শুধু ভালো থাকার নামে নিজেদের ভোগ বিলাস নিরাপদ করতে ব্যস্ত। একসময় স্নায়ুযুদ্ধের দুই প্রধান দেশ আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই ভাগে ভাগ হয়ে লড়াই করলেও তাদের চাপে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে বাধ্য হতো। এখন আর সেদিন নাই। এক দল আগ্রাসন করে আরেক দল হুমকি দেয়। কিন্তু পা বাড়ায় না। ঝুঁকি নেয় না কেউ। বরং উভয়েই পরম আগ্রহে অস্ত্র ব্যবসা করে। শুধু তাদের দোষ দিয়ে লাভ নাই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও এখন বিপথগামী। সভ্যতা সংস্কৃতি সব বাদ দিয়ে তারা যে উন্মাদনা আর ভয়াবহ খেলায় মেতে আছে তার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক যতটা তার চেয়ে বেশি আছে উগ্রতা। যে কারণে আজ তাদের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নামার পরও তারা আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া তুলতে ব্যর্থ।
এই শিশুটি তার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। বাচ্চাটি মুসলমান না অন্য কেউ সে পরিচয় বড় নয়, বড় তার নিরাপত্তাহীনতা। কতটা অনিরাপদ আর অসহায় হলে একটি শিশু একা এমন ঝুঁকি নিতে পারে? বোঝা যাচ্ছে মা-বাবা, ভাই-বোনদের কেউ হয়তো বেঁচে নাই। থাকলেও হারিয়ে গেছে। আর পাড়া প্রতিবেশী বলে যাদের আমরা আপন মনে করি তাদের জীবনও নিশ্চয়ই এমন এক তোপের মুখে যে কেউ কারও খবর রাখে না। বা রাখার মতো অনুভূতি কিংবা সুযোগ নাই আর। এমন দেশ, এমন সমাজ মানব সভ্যতার বিপরীতে দাঁড়ানো হবার পরও টনক নড়ে না কারও।
বাচ্চাটা ভাগ্যক্রমে জাতিসংঘের কর্তাদের হাতে পড়েছে বলে হয়তো জানে বেঁচে যাবে। এমনও হতে পারে কয়েক দিন খুব আলোচনায় থাকবে দুনিয়া জুড়ে। এটাই সভ্যতার এক চরম উপহাস। আজকাল মিডিয়ায় কাউকে ফোকাস করতে পারলেই তারা ভাবে তাদের দায়িত্ব শেষ। পাকিস্তানের মালালার কথা মনে করুন। কী হলো শেষতক? তাকে আকাশে উঠিয়ে ছেড়ে দিলেও পাকিস্তানে কি কোনো পরিবর্তন সাধন করা গেছে? না বদলেছে পাকিস্তানিদের মনোভাব? সে দেশে জঙ্গি হামলায় মানুষের জান যায় পাখির মতো। তারপরও তারা সঠিক কোনো কাজ করতে আগ্রহী না। এই শিশুটি আমাদের মতো কোটি মানুষের চোখে জল আনলেও রাজনীতির চোখে অশ্রু আনতে পারবে না।

এমন ঘটনা এখন কাউকে বিনিদ্র রাখে না। সামাজিক মাধ্যমে সাড়া তুলে কয়েক দিন পর তা হারিয়ে যায়। এতবড় একটা মানবিক কাহিনি পশ্চিমে হলে তার বিধান করতে যারা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তারা এখন মানবিকতার পতাকা উড়িয়েই নিজেদের দায় সারবেন। অথচ এই শিশু কলম্বাস দুর্গম গিরি কান্তার মরু পার হয়ে যে শান্তিপূর্ণ জীবনের পথ খুঁজছিল তার দিকে কেউ দৃষ্টি দেবে না।

দিলে সমস্যা জিইয়ে না রেখে তারা এমন আর কোনো বাচ্চার ঝুঁকি নেওয়া বন্ধের উদ্যোগ নিত। কী যে হয়েছে এই দুনিয়ার। কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান কেউ বৌদ্ধ কেউ খ্রিস্টান কেউ ইহুদি কিন্তু কেউ আর মানুষ না। এই কারণে মানুষ হবার জায়গাটা আজ সীমাবদ্ধ হতে হতে শূন্যে পৌঁছে গেছে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ছবিটি দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। বড় বেদনার ছবি। মানুষ কবে থেকে এত অমানবিক হয়ে উঠল যে মাসুম বাচ্চাকেও ছাড় দিচ্ছে না। তাদের কি বুকে আসলেই কোনো দয়া মায়া নাই আর? বাংলাদেশে যারা এর পেছনে ধর্মের উৎস খুঁজবেন তাদের জানাই আফ্রিকার নানা দেশেও এমন সমস্যা আছে। আছে দুনিয়ার বহু জাতিতে। সবার জন্য সমব্যথী না হতে পারলে মুক্তি অসম্ভব। কদিন আগে নিউজিল্যান্ডে যা ঘটল তার নাম কি শুধুই হত্যাকান্ড? নাকি এর পেছনে আছে সময়ের ইন্ধন? সময় ও অমানুষদের অশুভ প্ররোচনা? এমন ঘটনা যেকোনো সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে নামিয়ে আনতে পারে ঘোর বিপদ। কেউ আজ নিরাপদ না। সভ্যতা নিজেও অনিরাপদ।

এভাবে চলতে থাকলে একসময় মানব শূন্য ধরণী হয়ে গেলেও কি অবাক হব আমরা? দাপট আর বিভাজনের এই এক অপবিত্র যুগ চলছে। যেখানে আমি আমি বা আমরা আমরা ছাড়া সবার বলে কিছু নাই। সভ্যতার এমন অপমান সিরিয়া থেকে শুরু করে সব দেশেই বিরাজমান। এর প্রতিকার কোথায়? গোষ্ঠী জাতি সম্প্রদায়গত দাঙ্গা আগেও ছিল। সেগুলোকে পদানত করেই মানুষ রাষ্ট্র গড়ে তোলে যাতে ভালোভাবে নিরাপদে থাকতে পারে। সে রাষ্ট্র ধারণাই আজ প্রায় ভঙ্গুর। এমন দেশের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে যেখানে মানুষ কিছু না, মূল কথা দাপট আর সিংহাসন। এভাবে চললে সব বাচ্চাই একদিন এতিম হবে। পথ হারাবে মরু বা খরা কিংবা বৃষ্টির খোলা মাঠে। তা কি আমরা চাই?

জানি না মানুষ রুখে দাঁড়াতে পারবে কি না। তবে না পারলে তার জন্য এই দুনিয়া একসময় কাঁটায় ঘেরা এক অনিরাপদ ভ‚মিতে পরিণত হতে বাধ্য। শিশুর কান্না আর কষ্ট কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। এটাই সময়ের শেষ বিচার।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com