১১১মামুন রশীদ২২২
‘মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমরা বড় কম জানি।’ গণহত্যা নিয়ে একটি সেমিনারে কথাটি বলেছেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। বিভিন্ন দৈনিকে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মন্তব্যটি পড়ে চমকে উঠিনি। বরং এ সত্যটি এখনও আমাদের সবার সামনে কেন স্পষ্ট নয়, তাই নিয়ে ভেবেছি। আমাদের এই কম জানার কারণ কী? মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্বের। অথচ আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেই কম জানি। এর কারণ কী আমাদের অজ্ঞতা না অনাগ্রহ? এসব ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়েছে চিশতি শাহ হেলালুর রহমানের কথা। বগুড়ার এই ছাত্রনেতা ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৭০-৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের প্যারেডে নেতৃত্ব দেন। দৈনিক আজাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রতিনিধি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তখন ইকবাল হল) হল ছাত্র সংসদের পাঠাগার সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সহ-সভাপতি চিশতি শাহ হেলালুর রহমানকে একাত্তরের ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যক্তিগত আগ্রহে কয়েক বছর আগে যখন বগুড়ায় তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি, তখন জেনেছিলাম, চিশতি হেলালের পরিবার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের তালিকায় নেই। এটা কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনাগ্রহ বা কম জানার কারণে হয়নি। এটা হয়েছে আমাদের অবহেলায়। আমরা শুধু সামনে থাকা ঘটনাকেই মনে করতে চাই। পেছনের কথা মনে করি, কিন্তু তার সঙ্গে সম্পৃক্ত আর আর ঘটনার সংযোগ খোঁজার কষ্ট করতে চাই না। এই কষ্ট করার কাজটিই এখন করছে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণ কেন্দ্র। তাদের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, বধ্যভ‚মি ও গণকরবের অজানা তথ্য উঠে আসছে। আর সেই তথ্য প্রকাশ করতে গিয়েই অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের কম জানার বিষয়ে।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আগ্রহ বাড়িয়েছেন আমার বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম। তার কাছে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতাম। সেই শোনা কথা থেকেই ধারণা পাল্টাতে থাকে আমার। প্রশ্ন তৈরি হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার ধরন পাল্টাতে থাকে। পাল্টনোকে স্বীকার করে নিয়েই চলতে হয় পথ। অস্বীকার করলে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম আমার ভেতরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে জিজ্ঞাসা তৈরি করে দিয়েছেন, তা ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে আরও স্পষ্ট হচ্ছে। এর প্রমাণও পেতে শুরু করেছি। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা। আমার নতুন কর্মস্থল, দৈনিক ‘সময়ের আলো’ প্রথম পাতায় মার্চের শুরু থেকেই একজন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছে। প্রতিটি বর্ণনাই মনোযোগ দিয়ে পড়ি। সেখানে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের যে বর্ণনা, তাতে করে তারা নিজেদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার চেয়ে সেই সময়ে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, সাধারণ মানুষের সহায়তার কথাই বলেছেন বেশি করে। যা তাদের প্রেরণা দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধে। আসলে আমরা সাধারণে, সাদা চোখে মুক্তিযুদ্ধকে একটি ফ্রেমে বন্দি করে ফেলছি। মাত্র কয়েক লাইনে মুক্তিযুদ্ধকে সংজ্ঞায়িত করছি। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র কয়েকটি ঘটনার দিকেই নজর দিচ্ছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের যে ব্যাপকতা, মুক্তিযুদ্ধের যে উদ্দেশ্য, মুক্তির সংগ্রাম যে প্রকৃত অর্থেই জনযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল, সেই দিকটি নিয়ে আলোচনা এবং গবেষণা এখনও সীমিত। এখনও বিষয়টি দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে কারও কারও কাছে। আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি স্বাধীনতা, যা রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আসা স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কতজন শহীদ পরিবারের খোঁজ রাখি? রাষ্ট্র অথবা ব্যক্তি পর্যায়ের কয়টি অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবারকে সম্মানিত করি? আমরা এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সম্পন্ন করতে পারিনি। সেই তালিকা নিয়ে তৈরি জটিলতার ইতি টানতে আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এ তো আমাদের অপূর্ণতাই।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা এখনও চলমান। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটিও কতটুকু যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়, সেই প্রশ্নও রয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতো একটি বড় ঘটনার প্রকৃত ইতিহাস উঠে আসতে শুরু করে চার দশকেরও বেশি সময় পরে। আমরা ইতোমধ্যে পেরিয়ে এসেছি স্বাধীনতার চারটি দশক। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল এখন ক্ষমতায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধকে যেন কয়েকটি লাইনের ফ্রেমে বন্দি না করে তার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা হয় সে বিষয়ে প্রত্যাশা বেশি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাত কোটি। সেই জনসংখ্যার প্রায় তিন কোটি মানুষ এখনও জীবিত। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী এই তিন কোটি মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে নানা ঘটনা। সেসব লিপিবদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়েই প্রকৃত এবং পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস উঠে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাই জনযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে আনতে গবেষকের তীক্ষè দৃষ্টি, পরিশ্রম এবং তার যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। আর তাতে করে গবেষণার সমস্যা চিহ্নিতকরণ, প্রাসঙ্গিক গবেষণা ও তথ্য পর্যালোচনা, গবেষণার সমস্যা নির্দিষ্টকরণ, অনুমিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও গবেষণার প্রশ্ন নির্দিষ্টকরণ, তথ্য সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ ও বর্ণনাকরণ এবং প্রতিবেদন তৈরি ধাপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করতে যে বিশাল অর্থের প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এত বিশাল কাজ সম্ভব নয়, টাকার অভাবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের জন্য অনুক‚ল পরিবেশ বিরাজ করছে। কারণ, সরকারের আন্তরিকতা। এখন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার কাজটিকে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। চেনা পথের বাইরে এসে তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগী হতে হবে। সেই প্রক্রিয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যে গণহত্যা চালিয়েছিল, এক রাতে যত মানুষকে হত্যা করেছিল, সেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে ওই রাতের নিহতদের পরিবারদের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা প্রতিটি মানুষের মৌখিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে করে আগামী দিনের গবেষক, ইতিহাসবিদ মেলে ধরতে পারেন জনযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস।
লেখক : সাংবাদিক, কবি