কেমন আছে হাজারীবাগ
এসএম আলমগীর
প্রকাশ: রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৯, ১২:০০ এএম আপডেট: ২৪.০৩.২০১৯ ৭:২৫ পিএম

এখনও ট্যানারির মায়া ছাড়তে পারেনি হাজারীবাগ। এখানকার অনেক কারখানাতেই এখনও পশুর চামড়া প্রক্রিয়াকরণ কাজ হয় প্রতিদিন। বিশেষ করে স্পিøট (ত্রæটিযুক্ত চামড়া) ও ক্রাশড (প্রক্রিয়াকৃত চামড়া) চামড়ার কাজ চলছে হাজারীবাগে। তবে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে এখানে। সরেজমিনে হাজারীবাগে এ চিত্র দেখা গেছে।

অন্যদিকে হাজারীবাগে আগের সেই কর্মচাঞ্চল্যভাব এখন আর নেই, নেই ট্যানারির সেই উৎকট গন্ধ। সাভারের ট্যানারি পল্লী থেকে ফিনিশড, ক্রাশড ও স্পিøট  চামড়া ট্রাকে করে এনে হাজারীবাগের কারখানায় রাখা হয়। এসব চামড়া ট্রাকে করে নামিয়ে কারখানার ভেতরে রাখার কাজে কিছু শ্রমিককে ব্যস্ত দেখা গেল। তা ছাড়া দুয়েকটি কারখানায় ক্রাশড চামড়া কেমিক্যাল দিয়ে ধোয়ার কাজে কিছু শ্রমিককে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। হাজারীবাগের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শাহীন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, হাজারীবাগে এখন কাঁচা চামড়ার কোনো কারবার হয় না। তবে এখানকার কারখানাগুলোকে কিছু কিছু মালিক গুদাম হিসেবে ব্যবহার করেন। অধিকাংশ কারখানা তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, হাজারীবাগে ট্যানারি কারখানাগুলোর জায়গা আগামী দিনে কীভাবে বা কোন কাজে ব্যবহার করা হবে সে বিষয়টি এখনও সুরাহা হয়নি। এ ব্যাপারে আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি।
হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাজারীবাগে ট্যানারি পল্লীর মোট জমির পরিমাণ ৭০ বিঘা। পঞ্চাশের দশকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতীরে প্রথম ট্যানারি শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে চামড়া প্রক্রিয়াজাত শুরু হয়। অনুক‚ল পরিবেশের কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৪ সালের ২৪ জানুয়ারি বুড়িগঙ্গা নদীতীরে হাজারীবাগে ট্যানারি পল্লী স্থাপনের অনুমোদন দেয়। একই সঙ্গে ট্যানারি গড়ে তোলার জন্য হাজারীবাগের ওই ৭০ বিঘা জমির ওপর ট্যানারি শিল্প পল্লীর ‘লে-আউট প্ল্যান’ চ‚ড়ান্ত করা হয়। মাত্র ১৯টি ট্যানারি নিয়ে তখন এ পল্লীর যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরে দীর্ঘ সময়ে এখানে ছোট-বড় প্রায় ৬০০ ট্যানারি কারখানা গড়ে ওঠে।

প্রথমদিকে হাজারীবাগে গড়ে ওঠা কারখানাগুলোর সর্বনি¤œ আয়তন ১০ কাঠা আর সর্বোচ্চ আয়তন ছিল ২ বিঘা। কিন্তু পরে হাতবদলের মাধ্যমে প্লটগুলোর আকার ছোট হতে থাকে। একই সঙ্গে নির্ধারিত জায়গা ছেড়ে কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতেও ট্যানারি শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটে। সত্তরের দশকে জাতীয়করণ হলেও আশির দশকে আবার বেসরকারিকরণ হয় ট্যানারি শিল্প। নব্বইয়ের দশকে শিল্পটির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা। হাজারীবাগ ও আশপাশের এলাকা এবং বুড়িগঙ্গা নদীদূষণের কারণে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের দাবি ওঠে এবং পরিবেশবাদী সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়।

সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের হরিণধরা ও ঝাউচর গ্রামে ১৯৯ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় চামড়া শিল্পনগরী। সেখানে ২০৫টি প্লটে ১৫৫টি ট্যানারি মালিককে জায়গা দেওয়া হয়। অবশেষে দীর্ঘ ৬৩ বছর পর ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তর করা হয়।

হাজারীবাগ এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে রহমান লেদার কারখানার শ্রমিকরা স্পিলিট চামড়া ট্রাকে থেকে নামিয়ে গুদামে রাখছেন। এ কারখানার ভেতরে কয়েক হাজার স্কয়ার ফুট স্পিলিট ও ক্রাশড চামড়া গুদামজাত করে রাখা হয়েছে। এখানকার শ্রমিক মো. ইউসুফ বলেন, ‘সাভারের ট্যানারি কারখানা থেকে ট্রাকে করে চামড়াগুলো এখানে আনা হয়েছে। এগুলো আমরা গুদামজাত করছি। এখানে যাচাই-বাছাই করে এবং ছেঁড়া অংশগুলো বাদ দিয়ে এগুলো রফতানি করা হবে বিভিন্ন দেশে।

তিনি বলেন, এখন আর আগের মতো কর্মচাঞ্চল্য নেই হাজারীবাগে। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি ট্রাকে করে প্রক্রিয়াকৃত চামড়া আনা হয়। তখন আমরা এগুলো আনলোড করে গুদামে রাখি। আগে তো ঠ্যালাগাড়ি, ভ্যান গাড়ির জটলা লেগেই থাকত হাজারীবাগে। এখন অধিকাংশ সময় আমাদের বসে থাকতে হয়।

এশিয়া ট্যানারিতে দেখা গেল বেশ কয়েকজন শ্রমিক ক্রাশড চামড়া কেমিক্যাল দিয়ে ধৌত করছেন। এখানকার শ্রমিক মিজানুর রহমান বলেন, এসব চামড়া পরিস্কার করার জন্য মূলত কেমিক্যাল দিয়ে ধোয়া হয়।

তিনি বলেন, দিনের অধিকাংশ সময় অলস বসে থাকতে হয় আমাদের। কাজ নেই বললেই চলে। তবে আমরা যারা দীর্ঘদিন হাজারীবাগে চামড়ার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা ট্যানারির মায়া ছাড়তে পারিনি। চামড়ার গন্ধ নাকে না এলে আমাদের ভালো লাগে না। একই কারখানার সামনে মুদিখানার দোকান চালান ৬৩ বছর বয়স্ক নুরুল হুদা।

সময়ের আলোকে তিনি বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর আমি হাজারীবাগ এলাকায় এ ব্যবসা করি। যখন এখানে পুরোদমে কাজ চলত, মানুষ গিজগিজ করত। আমার দোকানে বেচাকেনাও ভালো ছিল। কিন্তু এখন লোকজনও কম, বিক্রিও কম। আগে যেখানে দিনে ১০ পন পান বিক্রি করেছি, সেখানে এখন সারা দিনে এক পন পানও বিক্রি হয় না। আগে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ পিস পাউরুটি বিক্রি হতো, কিন্তু এখন সারা দিনে ১০ পিসও বিক্রি হয় না। অর্থাৎ ট্যানারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে এখানে আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চরম সমস্যা হয়ে গেছে। অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা বন্ধ করে চলে গেছেন হাজারীবাগ ছেড়ে। অনেক ব্যবসায়ী পুঁজিহারা হয়ে গেছেন।

কী হবে হাজারীবাগের জমিতে : রাজধানীর হাজারীবাগে ট্যানারির পরিত্যক্ত জমি কাজে লাগাতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ট্যানারি কারখানাগুলো চলে গেলে খালি জমিতে নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়তে দেওয়া হবে না। এখানকার প্রতি ইঞ্চি জমিতে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায় সরকার। এরই মধ্যে এ বিষয়ে একটি খসড়া রূপরেখা তৈরির কাজে হাত দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হাজারীবাগের জমিতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা শতভাগ নিশ্চিত করতে বহুতলবিশিষ্ট বহুমুখী বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হতে পারে। এখানে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। ভবনটির ১০ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক কর্মকাÐে ব্যবহার করা হবে। বাকি তলাগুলো হবে আবাসিক। ট্যানারির জমিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। সেখানে অনুমোদনহীন কোনো স্থাপনা নির্মাণ হতে দেবে না শিল্প মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্র জানায়, হাজারীবাগকে আধুনিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর সেখানে কাজ শুরু হবে। তবে ওই অঞ্চলে অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা রয়েছে। অনেক জায়গার ওপর বিপুল অঙ্কের ব্যাংক ঋণ নেওয়া আছে। সরকার এগুলোকে কীভাবে সমন্বয় করবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে বিষয়টি এখন সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-২২৬৬৩৯০১৮, ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com